কোলে-স্টেরল সম্পর্কে ভুল ধারণা
কয়েক দশক ধরে আমাদের চিকিৎসকরা বলে আসছেন, কোলে-স্টেরল স্ট্রোক ও
হৃদ রোগের মূল কারণ এবং এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের রক্তে কোলে- স্টেরলের মাত্রা কমাতে হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ১৯৮৭ সালে ‘দ্য জার্নাল অব দি অ্যামেরিকান মেডিকেল অ্যাসো- সিয়েশনে’ প্রকাশ করেন, পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের মৃত্যুর কারণের সঙ্গে রক্তে
কোলে – স্টেরলের মাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরও
দেখা যায় কোলে-স্টেরলের মাত্রা বেশি
কমে গেলে শরীরের বিভিন্ন মেটাবলিক ডিজ অর্ডার তৈরি হয়। এখানেই শেষ নয়।
অতি সম্প্রতি ‘দ্য জার্নাল অব কার্ডিয়াক ফেলিয়ার’ ও জার্নাল ‘ল্যানসেট’ প্রকাশ করেছে, রক্তে কোলে-স্টেরলের মাত্রা কমে গেলে জটিল হৃদ রোগীদের মৃত্যু হার বেড়ে যায়। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত কোলে-স্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি পূর্ণ নয়। কিন্তু কোলে- স্টেরলকে উচ্চ তাপে রান্না করা হলে বা পোড়ানো হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। ১০০ ডিগ্রি সেন্টি গ্রেড তাপ মাত্রায় কোলে-স্টেরল সহজে পরিবর্তনীয় নয়। কিন্তু ১২০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপ মাত্রায় এক ঘণ্টা রান্না করা হলে কোলে-স্টেরল অক্সি-ডাইজে-শনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক যৌগে রূপান্ত- রিত হয়। এগুলোকে ক্ষতিকর (Damaged),
কোলে-স্টেরল বলা হয়। এসব ক্ষতি কর উপাদানের মধ্যে রয়েছে ৭-আলফা হাই- ড্রোক্সি-কোলে-স্টেরল, ৭-বিটা হাই-ড্রোক্সি- কোলে-স্টেরল, ৫-আলফা- ইপক্সি-কোলে- স্টেরল, ৫-বিটা ইপক্সি-কোলে-স্টেরল,
কোলে-স্টেন-ট্রায়ল ও ৭ কিটো-কোলে- স্টেরল।
প্রকৃত অর্থে ব্যাড কোলে-স্টেরল বলতে এসব ক্ষতি কর যৌগ-গুলো-কেই বোঝানো হয়। এছাড়া কোলে-স্টেরলকে ব্যাড
কোলে-স্টেরল বা গুড কোলে-স্টেরল বলে আখ্যায়িত করা ঠিক নয়।
তবে মাত্রা তিরিক্ত পরিমাণে সব কোলে- স্টেরলই খারাপ। পরিমিত পরিমাণে কোনো কোলে-স্টেরলই খারাপ নয়। এলডিএল কোলে-স্টেরলের খারাপ দিকটাই এক শ্রেণির মানুষ দেখতে বেশি পছন্দ করে।
শরীরে এলডিএল কোলে-স্টেরলের অসংখ্য ভালো কাজ গুলোর কথা কি আমরা স্বীকার করি?
২০০ ডিগ্রি সেন্টি গ্রেড তাপ মাত্রায় উত্তপ্ত
করা হলে কোলে-স্টেরলের গাঠনিক সংকেত (Structure) পুরো ভেঙে যায়।
যেসব খাবার রান্না করার জন্য ১২০ ডিগ্রির বেশি তাপ মাত্রার দরকার হয় সেসব খাবারে বিদ্যমান কোলে-স্টেরল স্বাস্থ্যো-পযোগী থাকে না ক্ষতি কর কোলে-স্টেরলে রূপান্তরিত হয়। কোলে-স্টেরল সমৃদ্ধ প্রাণিজ খাবার যেমন: খাসি, গরু, মহিষ জাতীয় পশুর মাংস উচ্চ তাপে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করতে হয় বলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি পূর্ণ। কেউ যদি প্রতি নিয়ত ক্ষতি কর
কোলে-স্টেরল ও ফ্রি রেডিক্যাল সমৃদ্ধ খাবার খায় তবে এ সব ক্ষতি কর উপাদান রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে এবং ক্রমান্বয়ে
শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরের গায়ে সৃষ্ট ক্ষতে জমতে শুরু করবে।
তাই কেলে-স্টেরল-সমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘক্ষণ উচ্চ তাপে রান্না বা পোড়া তেলে ভাজা আপনার স্ট্রোক ও হৃদ রোগের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।
কোলে-স্টেরল আমাদের শরীরের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রাসায়নিক যৌগ। শরীরে পর্যাপ্ত কোলে-স্টেরল না থাকলে ভিটামিন ডি, টেস্টো-স্টেরন, ইসট্রো-জেন ও অ্যালডো-স্টেরন জাতীয় অত্যাবশ্য-কীয় হরমোন উৎপাদন কমে যাবে। ফলে শরীরে কোলে-স্টেরলের মাত্রা কমে গেলে অসুস্থতার উপসর্গ দেখা দেবে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং শরীরে হতাশা বাসা বাঁধবে।
কোলে-স্টেরল কমানোর জন্য চিকিৎসকরা যাদের স্ট্যাটিন গ্রুপের (জেনেরিক : অ্যাটর-ভেস্ট্যা-টিন, ব্র্যান্ড : লিপিটর,
ম্যাভাকর, যুকর, প্যাবাকল, ল্যাসকল) ঔষধ প্রদান করেন, তাদের যৌন ক্ষমতা বা
যৌন বাসনা প্রায় ক্ষেত্রে হ্রাস পায় নতুবা বিনষ্ট হয়ে যায় (Loss of libido)।
এ সমস্যা নিয়ে অনেক রোগীকে আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। অনেক চিকিৎসক তখন রোগীকে ভায়াগ্রা বা ওই জাতীয় বিপজ্জনক ঔষধ গ্রহণ করা বা এমন সব পরামর্শ দেন যা করলে তাকে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আরও একটি গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য মনে রাখা দরকার।আমাদের শরীরের কয়েক ট্রিলিয়ন কোষের প্রাচীর,
তৈরির জন্য কোলে-স্টেরল একটি অত্যা- বশ্য-কীয় উপাদান।
কোলে-স্টেরলের অভাবে কোষ প্রাচীর তৈরি হয় না বলে শরীরে পর্যাপ্ত কোলে-স্টেরল থাকা বাধ্যতামূলক। মস্তিষ্কের মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ কোলেস্টেরল।
পর্যাপ্ত কোলে-স্টেরলের অভাবে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এত কিছুর পরও চিকিৎসকরা রোগীকে কোলে-স্টেরল কমানোর জন্য একেবারে চকলেট বা ক্যান্ডির মতো উচ্চ মাত্রার স্ট্যাটিন গ্রুপের ঔষধ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ রোগীর মধ্যে এ গ্রুপের ঔষধ, কোনো কাজই করে না বা করলেও তা নগণ্য পরিমাণে করে।
‘কোচরান লাইব্রেরি’ কর্তৃক প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৪ হাজার রোগীর মধ্যে স্ট্যাটিনের ১৪টি ট্রায়ালের ফলাফলে রোগীদের মধ্যে হতাশা,মেজাজ পরিবর্তন, যকৃতের সমস্যা বা কর্ম ক্ষমতা হ্রাস, কিডনি বিকল হওয়া, চেখে ছানি পড়া, পেশি ক্ষতি গ্রস্ত হওয়া ও সাময়িক স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া অন্যতম বলে প্রমাণিত হয়েছে। সারা বিশ্বে এখন, স্ট্যাটিন গ্রুপের ঔষধের রাজত্ব চলছে। ২০০৭ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে লিপি- টরের বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় আট বিলিয়ন ডলার।
আর সারা বিশ্বে এর বিক্রির পরিমাণ ছিল কম করে হলেও ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা ৫ কোটি ৭০ লাখ রোগীকে লিপিটর প্রেসক্রাইব করে- ছিলেন।
কেন এত মানুষ, অ্যান্টি-কোলে -স্টেরল ওষুধ গ্রহণ করে?
এজন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের একটা বড় ভূমিকা আছে। ২০০৪ সালে চিকিৎসকদের একটি দল স্ট্রোক আর হৃদ রোগের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে এলডি- এলের স্বাভাবিক মাত্রা ১৩০ থেকে ১০০-তে নামিয়ে আনেন। হৃদ রোগের ঝুঁকি কমানোর নাম করে তারা আবার এলডিএলের মাত্রা ১০০ থেকে ৭০-এ নামিয়ে আনেন।