ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স বিষয়ে বাংলাদেশ সংলাপঃ
বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের আয়োজনে ও আইএসপিএবি’র সহযোগিতায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর আম্বার আইটির কনফারেন্স রুমে ‘বাংলাদেশ ডায়ালগ অন ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স’ শীর্ষক এক সংলাপের আয়োজন করা হয়।
উক্ত সংলাপের সময়কাল ছিল ১৮০ মিনিট। এখানে অংশ নেন সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে ৩ জন, অ্যাকাডেমিয়ার ১ জন, বিজনেস কমিউনিটির ৩ জন, কারিগরি কমিউনিটির ৪ জন, মিডিয়ার ৩ জন এবং সরকারি ১ জন।
সংলাপের শুরুতে বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (বিআইজিএফ) মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হক অনু ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের ওপর একটি ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শন করেন।
এরপর জাতিসংঘ কেনো ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম সৃষ্টি করে তার ওপর পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেনট্রেশন উপস্থাপন করে।
সেখানে আইজিএফ, এপিআরআইজিএফ এবং বিআইজিএফ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়।
সেই সাথে ৬-৯ ডিসেম্বর মেক্সিকোতে ১১তম ইউএনআইজিএফ হবে তাও জানানো হয়।
এরপর সংলাপ শুরু হয়। সংলাপে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবদুল হক অনু।
বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটর্স গ্রম্নপের (বিডিনগ) চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির বলেন, প্রথমে আমাদের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এরপর সমাধানের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
যদি আমরা না পারি তাহলে এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (এপিআরআইজিএফ) সাহায্য নিতে হবে।
সেখানেও সমাধান না হলে ইউএনআইজিএফ-এর সাথে যোগাযোগ করে সমাধান করতে হবে।
আইপিভি ৬ আরও কীভাবে জনপ্রিয় করা যায়, সে লক্ষে একত্রে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষেরা যাতে সহজে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ইন্টারনেট পলিসির ক্ষেত্রে একসাথে বিআইজিএফ ও আইএসপিএবির কাজ করতে হবে।
যেমন- স্কাইপি, ভাইবার, হোয়াটসআপসহ বিভিন্ন বিদেশী সার্ভিসের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ কথা বলতে পারে।
অথচ দেশীয় কোনো কোম্পানি এ ধরনের কোনো সার্ভিস চালু করে ব্যবসায় করতে পারবে না।
অতি সম্প্রতি বিটিআরসি থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে বাংলাদেশের কোনো আইএসপি সার্ভিস প্রোভাইডার আইপিটিভি সার্ভিস দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের (বিআইজেএফ) সভাপতি মোহাম্মদ খান বলেন, ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের সব কর্মকাকে আমরা অতীতের মতো লেখালেখির মাধ্যমে সাপোর্ট দিয়ে যাব।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান সাদিক ইকবাল বলেন, এখন মানুষের অন্য মৌলিক চাহিদার সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট পলিশিটিকে ঢাকা কেন্দ্রিক থেকে দূর করে ঢাকার বাইরের জনগণের কথা চিন্তা করে ঠিক করতে হবে।
সামনে আসছে বিগডাটা ও ক্লাউড কমপিউটিং। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনই আমাদের ভাবতে হবে।
বাংলাদেশে ভিডিও কনফারেন্স করতে হলে বিটিআরসি’র কাছ থেকে আগে অনুমতি নিতে হয় এবং সেই সাথে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়।
অথচ স্কাইপিসহ নানা প্রযুক্তির মাধ্যমে আমি বিনা টাকায় ভিডিও কনফারেন্স করতে পারি।
তাই এসব বিষয়ে সরকারের সাথে সংলাপ করা দরকার।
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনস (বিএনএনআরসি)’র সিইও এএইচএম বজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামকে প্রথমত পাঁচটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে- ০১. অবকাঠামো, ০২. আইন, ০৩. অর্থনীতি, ০৪. উন্নয়ন ও ০৫. সামাজিক, সংস্কৃতির নিরাপত্তা।
বিআইজিএফকে আরও বেশি ইনক্লিউসিভ হতে হবে। তাকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে।
মিডিয়ার স্টেকহোল্ডোদের এগিয়ে আসতে হবে তাদের স্বার্থেই।
কারণ দেখা যাচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রিন্ট সংস্করনের জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুগের সাথে তাল মিলাতে সে অনলাইন এবং ভিডিও সংস্করনও চালু করছে।
তাহলে কি তাকে একেকটার জন্য আলাদা আলাদা অনুমোদন নিতে হবে। বিষয়গুলো এখন ভেবে দেখার বিষয়।
ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সর্বোপরি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে সরকারকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে।
আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, বজলু ভাইয়ের কথার সাথে একমত হয়ে আমি বলছি- অবকাঠামো, আইন, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও সামাজিক, সংস্কৃতির নিরাপত্তা এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংক্রান্ত ৯০ শতাংশ সমস্যা সমাধান সম্ভব।
সরকার গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট দিচ্ছে, কিন্তু আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সাথে কথা বলছে না।
বিটিআরসি ইন্টারনেট সার্ভিসের জন্য যে চারটি লেয়ারে লাইসেন্স দিয়েছে অর্থাৎ ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের এত লেয়ার দরকার আছে কি না তা নিয়েও ভাবতে হবে।
বাংলা উইকিপিডিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নূরুন্নবী চৌধুরী বলেন, ডটবাংলা ডোমেইন কেনো এখনও হচ্ছে না তার ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।
ওপেন ডাটা নিয়ে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি ইন্টারনেট সংক্রান্ত সব আইনকে একই ছাতার তলে আনতে হবে।
ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধাটি ঢাকা কেন্দ্রিক। এটিকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট সবার জন্য।
মিডিয়া অ্যান্ড গভর্ন্যান্স এক্সপার্ট ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও যাত্রী’র জামিল আহমেদ বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোকে এই ফোরামে যোগ করতে হবে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স সংক্রান্ত স্থানীয় বিষয়ে কথা বলতে হবে।
শোম কমিউনিকেশন লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আফরোজা হক রিনা বলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারী, শিশু ও রাষ্ট্র যাতে নিরাপদ থাকে, সে লক্ষ্যে বিআইজিএফকে এগিয়ে আসতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করতে হবে আমাদের। সর্বোপরি বিআইজিএফকে আরও বেশি অ্যাকটিভ হতে হবে।
ইন্টারনেট সোসাইটি (আইএসওসি) বাংলাদেশ ঢাকা চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি মো: জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমাদের সরকারের সাথে ইন্টারনেট সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে কাজ করতে হবে।
রিজিওনাল লেভেলে বিআইজিএফের পক্ষ থেকে কান্ট্রি পেপার উপস্থাপন করা দরকার।
Internet Corporation for Assigned Names and Numbers (ICANN)-এর Governmental Advisory Committee (GAC)-এ বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিনিধি নেই।
সে ব্যাপারে সরকারকে জানাতে হবে। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স Internet Assigned Numbers Authority (IANA) Stewardship Transition-এ বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া উচিত।
ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ব্যবস্থাপনা কি আমেরিকা সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা -এর হাতে থাকবে নাকি জাতিসংঘ কর্তৃক নিরপেক্ষ কোনো সংস্থা পরিচালনা করবে।
আমাদের দেশে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স নিয়ে সচরাচর আলোচনা হয় না।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের আজকের আয়োজন এই অপূর্ণতাকে অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন পথ নির্দেশ করবে।
এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরও দৃশ্যমান হবে।
মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিতব্য আইজিএফ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি কান্ট্রি পজিশন পেপার তৈরি করতে হবে এবং বাংলাদেশ আইজিএফের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ আইজিএফকে বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের আরও বেশি অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
গিগাবাইট টেকনোলজি কোম্পানির বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার খাজা মো: আনাস খান বলেন, ইন্টারনেট সার্ভিসকে একটি নীতিমালার আওতায় আনা উচিত।
সেই সাথে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের বিষয়গুলো সম্পর্কে তরুণ সমাজের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পেইন চালাতে হবে এবং সেখানে ফোরাম করতে হবে।
আইজিএফ একাডেমির ফেলো মোহাম্মদ কাওসার উদ্দিন বলেন, বিআইজিএফ-কে আরও বেশি গতিশীল হতে হবে। তার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তার ওয়েবসাইটকে যুগোপযোগী হতে হবে।
সেক্রেটারিয়েটকে প্রয়োজনে অর্থের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
শ্রীলঙ্কা থেকে স্কাইপে এশিয়া-প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (অ্যাপনিক) ট্রেনিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল ম্যানেজার নূরুল ইসলাম রোমান বলেন, আজকের ডায়ালগটি সব মহলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে ।