ই-কমার্স : বাংলাদেশে অনলাইনে ব্যবসা করতে যেভাবে নিবন্ধন করতে পারবেন একজনউদ্যোক্তা :
বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রসার ঘটছে ধীরে ধীরে।
বাংলাদেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে।
এখন থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে সকল কোম্পানিকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর নিতে হবে।
এমনকি যারা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করবেন তাদেরও এই আইডি লাগবে বৈধভাবে ব্যবসা করার জন্য।
এর নাম দেয়া হয়েছে ডিজিটাল-কমার্স বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা ডিবিআইডি ।
এজন্য ডিবিআইডি নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে বলে বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যদিও এখনো প্লে-স্টোরে সেই অ্যাপ দেখা যাচ্ছে না। এখন ওয়েবপেইজে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
নিবন্ধন কেন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ?
বাংলাদেশে প্রায় এক যুগ ধরে অনলাইনে ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
কিন্তু গত বছর দুয়েক ধরে ই-কমার্স খাতে নানা ধরণের অনিয়মের অভিযোগ শোনা যেতে থাকে।
এর মধ্যে ২০২১ সালের কাছাকাছি সময়ে ই-ভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে।
ব্যাপক সংখ্যক অভিযোগের প্রেক্ষাপটে সরকার বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়।
সে সময় দেখা যায়, দেশে ই-কমার্স পরিচালনার কোন নীতিমালা ছিল না এবং ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থাও ছিল না।
এমন অবস্থায় জুলাই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ নামে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে।
যাতে অর্ডার নেয়া, ডেলিভারি এবং অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত নীতিমালা তুলে ধরা হয়।
ই-কমার্স খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে সেপ্টেম্বর মাসে সরকার একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
সে সময়ই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে এ খাতের উদ্যোক্তাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, এই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে পরিচিতি নম্বর ধরে সরকার উদ্যোক্তার কর্মকাণ্ড ‘ট্র্যাক’ করতে পারবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সব ধরনের পণ্যই অনলাইনে কেনা-বেচা হয়।
“তারা কে কী কাজ করছে তা সরকার জানত না। তারা বৈধভাবে কাজ করছে কি না, কিংবা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কি না বা কোন অনিয়ম হচ্ছে কি না।
সেটা আগে দেখা সম্ভব ছিল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য।
কিন্তু এখন আমরা তাদের কাজ ট্র্যাক করতে এবং মনিটর করতে পারবো,” বলছেন মি. সফিকুজ্জামান।
শুরুতে এটি হবার কথা ছিল ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন বা ইউবিআইডি। কিন্তু পরে সেটি বদলে ডিবিআইডি করা হয়।
তিনি কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে, “ইউবিআইডি করার চিন্তা থেকে আপাতত আমরা সরে এসেছি।
কারণ আমাদের অনেক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন যাদের ট্রেড লাইসেন্স নেই।
কেউ আছেন যারা ফেসবুকে ছোট আকারে ব্যবসা করেন, তাদের ইউনিক বিজনেস আইডি দেয়া যেত না।
সে কারণে সবাইকে যাতে আমরা সাধারণভাবে নিবন্ধন দিতে পারি সেজন্য এটিকে আরো সরল করে ডিবিআইডি করা হয়েছে।”
এখন এই নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মি. সফিকুজ্জামান বলেছেন, এখন থেকে কোন ই-কমার্স উদ্যোক্তার যদি ডিবিআইডি না থাকে তাহলে তাকে বৈধতার স্বীকৃতি দেবে না সরকার।
কিভাবে নিবন্ধন করবেন একজন উদ্যোক্তা ?
একজন উদ্যোক্তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেইজ, বা যৌথ-মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর বা আরজেএসসি’র পেইজ অথবা মাইগভ ডট বিডিতে গিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেইজে অভ্যন্তরীণ ই-সেবাসমূহ কলামের নিচে রয়েছে ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের লিংক।
এতে ক্লিক করলে সেটি নিয়ে যাবে ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের জন্য আবেদন নামে একটি পেজে।
এখানে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের তালিকা এবং আবেদন ফরম পূরণের নিয়মাবলী উল্লেখ করা হয়েছে।
নিবন্ধনের জন্য একজন উদ্যোক্তাকে বাধ্যতামূলক- ভাবে নিজের ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্রের সত্যায়িত কপি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের জাতীয় পরিচয় পত্রের সত্যায়িত কপি দিতে হবে।
এ ছাড়া বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু দিতে পারলে ভালো হয় এমন কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে— আবেদনকারীর স্বাক্ষর, আয়কর নিবন্ধন নম্বর বা টিআইএন, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর, বাড়ির মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, এবং ভাড়া অফিসের ক্ষেত্রে বাড়ি ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে সম্পাদিত চুক্তির দলিলের সত্যায়িত কপি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মি. সফিকুজ্জামান বলেছেন, কেউ যদি নিবন্ধনের সময় সব কয়টি ঘর পূরণ করতে পারেন, তাহলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে যাবেন এবং তৎক্ষণাৎ নিজের নিবন্ধন নম্বর পেয়ে যাবেন।
যাদের টিআইএন, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ট্রেড লাইসেন্স বা ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর থাকবে না, তাদের নিবন্ধিত হতে সময় লাগবে।
ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের সময়সীমা বলা হয়েছে ৩০ দিন।
নিবন্ধনের পক্ষে-বিপক্ষে উদ্যোক্তারা :
যশোরের একজন উদ্যোক্তা শারমিন রুপালী ফেসবুকে ঘি, মধু, খেজুর গুড়, শুঁটকী মাছ এবং মৌসুমি ফল বিক্রি করেন।
তিনি বলছিলেন, নিবন্ধনের বিষয়টি সম্পর্কে থানা পর্যায়ে তারা বিস্তারিত শোনেননি।
কিন্তু তিনি মনে করেন যে, এই নিবন্ধন শুরু হলে সেটি ‘আখেরে ফল দেবে’ তাদের।
তিনি বলছিলেন, “এইটা এই জন্য ভালো যে, নিবন্ধন থাকলে তখন যে দোষী বা ভুয়া এবং প্রতারণা করেছে, সরাসরি তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার।
কিন্তু এখন যেটা হয় যে একজন দোষ করলে ঢালাওভাবে সকলের বদনাম হয়। সেটা হবে না।”
তিনি বলছিলেন, অনলাইন অর্ডারে গ্রাহকেরা পণ্যে ভেজাল পেলে একই ধরণের অন্য উদ্যোক্তাদেরও অবিশ্বাস করে।
“দেখা যায়, ভুল করেছে বা মানসম্মত পণ্য দেয়নি একজন ঘি-মধু-গুড় ব্যবসায়ী, কিন্তু তার জন্য আমাদের আস্থা অর্জনে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়।”
আরেক দল উদ্যোক্তা বলছেন, যাদের টিআইএন, ট্রেড লাইসেন্স বা ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর নেই, তাদের তো নিবন্ধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাথে সাথে হবে না।
তাদের আবেদন প্রথমে মন্ত্রণালয়ে এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে যাবে, সেখান থেকে যাচাই-বাছাই হয়ে কতদিনে নিবন্ধন সম্পন্ন হবে সেটি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।
ঢাকার একজন নারী উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করে বলছিলেন, “আমার একটা ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য যে পরিমাণ হয়রানি হতে হয়েছে, তা বর্ণনার যোগ্য না।
কাজ দ্রুত করার জন্য একজনকে টাকা দিতে হয়েছে, কিন্তু তারপরেও তিন মাস সময় লেগেছে।”
তার আশংকা এই নিবন্ধনের জন্যে তার মত ছোট বিনিয়োগ যেসব উদ্যোক্তার তাদের আরেক দফা কষ্ট বাড়বে।
“যেহেতু নিবন্ধন ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বৈধতা থাকবে না বলা হচ্ছে, তার ফলে হয়ত দেখা যাবে আমরা নতুন ধরণের হয়রানির মধ্যে পড়বো।
দেখা গেল হয়ত জরিমানা করতে আসবে কোন সংস্থা,” আশংকা ওই নারী উদ্যোক্তার।
বাংলাদেশে ট্রেড লাইসেন্সসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি এবং কাগজপত্র তৈরিতে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ রয়েছে।
ফলে উদ্যোক্তারা সে বিষয়টির দিকে সরকার যাতে নজর দেয় সে আহ্বান জানিয়েছেন।