গলা ও বুক জ্বালাপোড়ায় করণীয়

১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে প্রতি নভেম্বরে GERD সচেতনতা সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিতায় চলতি বছরও ২১ থেকে ২৭ নভেম্বর বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও গলা-বুক জ্বালাপোড়া প্রতিরোধ সচেতনতা সপ্তাহ পালিত হবে ।
অনেক রোগী ডাক্তারদের কাছে গিয়ে বলেন-মাঝে মাঝেই টক ঢেঁকুর ওঠে বা মুখে তিতা লাগে, গলায় জ্বালাপোড়া করে, খাবার গিলতে কষ্ট হয়, খাবার অনেক সময় ওপরে উঠে আসে। কেউ কেউ আরও বলেন, মনে হয় কিছু আটকে আছে গলায় । অনেক সময় গলা ভাঙার উপসর্গ দেখা যায় বুক জ্বালার সঙ্গে । হরহামেশাই গলা-বুক জ্বালাপোড়ার এ উপসর্গগুলোতে লোকজনকে ভুগতে দেখা যায় এবং এটা রোগীর স্বাভাবিক জীবন যাপনের মানকে ব্যাহত করে।
এসব ক্ষেত্রে ডাক্তাররা গলা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন কোনো ধরনের প্যাথলজি (ক্ষত) বা প্রদাহ পান না তখন একে GERD (Gastro Oesophageal Reflxu Disorder) বলে ডায়াগনসিস করে থাকেন। বিশ্বে এ সমস্যায় ভুগে থাকেন প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১৫ জন ।এ রোগের প্রকোপ বেশি ইউরোপ ও আমেরিকায় । আশঙ্কাজনকভাবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ রোগের ব্যাপকতা দিন দিন বাড়ছে । প্রতিরোধ সম্পর্কে কম জানার কারণে অনেককে নানা জটিলতায় ভুগতে হয় এবং বেশি বেশি ওষুধ খেতে হয়।

গলা-বুক জ্বালাপোড়া কেন হয়ঃ
গ্যাস্ট্রো বলতে আমরা পাকস্থলীকে বুঝে থাকি আর ইসোফেগাস হচ্ছে খাদ্যনালি । আমাদের খাবার গ্রহণের পদ্ধতিটি একমুখী। খাবার খাদ্যনালি হয়ে পাকস্থলীতে যায়। কোনো কারণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে তখন খাবার নিচের দিকে না গিয়ে ওপরে উঠে আসে। তখনই পাচক রস বা এসিড পাকস্থলী থেকে ওপরে চলে আসার কারণে গলা ও বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা তৈরি হয়।
জীবনযাত্রার কিছু ভুল পদ্ধতি এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু বিষয় রয়েছে যার কারণে এ রোগ সৃষ্টি হয় বা বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।

গলা ও বুক জ্বালাপোড়া সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আছেনঃ
১) যারা ওজনাধিক্য বা স্থূলতায় ভুগছেন,
২) যারা ধূমপান করেন,
৩) যারা ঘনঘন অধিক পরমাণে খাবার খান,৪)খাবার গ্রহণের পরপরই যারা শুয়ে পড়েন,
৫) যারা অধিক পরিমাণে পোড়া তেলে
ভাজা খাবার খান ,
৬) যারা অধিক পরিমাণে কোমল পানীয় ও অসময়ে কফি পান করে থাকেন,
৭. গর্ভবতীরা।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে গলা বা বুক জ্বালাপোড়াকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। অনেক সময় হৃদরোগের কারণেও বুক জ্বালাপোড়া করতে পারে। রিফ্লাক্স ডিজিজ GERD-এর কারণে হার্টবার্ণ হলে রোগীর বুকে অস্বস্তিকর জ্বালাপোড়া অনুভূতি বা ব্যথা হবে, যা রোগীর গলা পর্যন্ত যেতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের কারণে গলা-বুক জ্বালাপোড়া হলে এর সঙ্গে বাম হাত, বাম ঘাড় এবং চোয়ালে ব্যথা হবে, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বমি বমি ভাব, চরম ক্লান্তি, উদ্বেগ ইত্যাদি লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে।

প্রতিরোধ যেভাবে করবেনঃ

  • ক্ষুধা পেলে একবারে অনেকটা খেয়ে ফেলা আমাদের স্বভাব। একসঙ্গে অনেক খাবার খাবেন না। সারা দিনে অল্প পরিমাণ করে খাবারকে ভাগ করে খাবেন।
  • খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে। তাড়াহুড়ায় ভালো করে না চিবানোর ফলে খাবার ভালো করে হজম হয় না। এতে গ্যাস্ট্রিক এসিডিটির প্রবণতা বাড়ে।
  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা আগেই খাবার গ্রহণের অভ্যাস করতে হবে। তা না হলে যদি শোবার ঠিক আগে আগেই খাবার খান, তাহলে ভরপেট অম্লরসকে খাদ্যনালি দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলবে। এতে বুক জ্বালা করবে।
  • মানসিক চাপে যেহেতু পাকস্থলীতে অম্লরস নিঃসরণ বাড়ে, তাই যতটা সম্ভব চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোমরের বাঁধন শিথিল করে শোবেন অর্থাৎ ঢিলেঢালা কাপড় পরে ঘুমাবেন।
  • ভরা পেটে কখনই ব্যায়াম করবেন না, বিশেষতঃ পেটের ওপর চাপ পড়ে এমন ব্যায়াম। শরীরের বাড়তি ওজন কমাতে সঠিক সময়ে শরীরচর্চার বিকল্প নেই।
  • কোনো কোনো ওষুধ বুক জ্বালার সমস্যাটা বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন অ্যাসপিরিন/ব্যাথানাশক। এগুলো কখন কীভাবে খেতে হবে, তা চিকিৎসকের কাছে জেনে নিন।
  • যারা এ সমস্যায় ভুগছেন তারা খাবার পর শোবার সময় মাথার দিকটা পায়ের দিকের তুলনায় উঁচুতে রাখবেন। এ জন্য মাথার নিচে অতিরিক্ত বালিশ দিয়ে ঘুমাতে পারেন।
  • প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করবেন।

চিকিৎসাঃ
যদি বারবার এ সমস্যা দেখা দেওয়ার ফলে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। অথবা ৩ সপ্তাহের অধিক সময় ধরে এ গলা এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এ চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (PPI) দেওয়া হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগের চিকিৎসা কিছু দিন নিতে হয়, এটা হতে পারে মাস অথবা বছর । GERD বা গলা-বুক জ্বালাপোড়া সাধারণতঃ কোনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে না, যদি কেউ সঠিক চিকিৎসা না নিয়ে থাকেন তাহলে এ রোগ মারাত্মক ও বিপজ্জনক হতে পারে।

শারীরিক সমস্যার মধ্যে বুক ও গলা জ্বালাপোড়া একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে একবারের জন্যও বুক জ্বালাপোড়া সমস্যায় ভুগে নাই।

গলা ও বুক জ্বালা-পোড়া কী?
বুক জ্বালা পোড়া হচ্ছে-বুকের ভিতরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত জ্বালাকর অনুভুতি। এই জ্বালা কখনও কখনও শুধু বুকে আবার কখনও কখনও শুধু গলায় বা উভয় স্থানে হতে পারে। মাঝে মাঝে জ্বালার সাথে ব্যথ্যা থাকতে পারে। যদি কারও বুক জ্বালা-পোড়া করে, গলায় জ্বলুনি হয়, কিংবা গলার ভেতরের দিকে ঝাল, টক বা লবণাক্ত কোনো তরলের অস্তিত্ব অনুভুত হয়, সেই সঙ্গে ঢেকুর উঠে তাহলে ধরে নিতে হবে এগুলো  গ্যাসের সমস্যা থেকে তৈরি হয়েছে।  আর যদি বুকের জ্বালা-পোড়া যদি খুব বেশি হয়, পাশাপাশি এ ধরনের অস্বস্তিসহ ব্যথা বুক থেকে বাহু ও কাঁধের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তাহলে ঋদযন্ত্রের কোন সমস্যার কারণে হচ্ছে কিনা সেটি মাথায় রাখতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত ঋদরোগ
বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। অনেকেই হঠাৎ বুক জ্বালা-পোড়া হওয়া মাত্রই অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ খেয়ে ফেলেন। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত ঋৎস্পন্দন, কিডনি রোগ, পায়ুনালির সমস্যা কিংবা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কোনো লক্ষণ আছে কি না, সে ব্যাপারে চিকিৎসকের  সাথে পরামর্শ না করে অ্যান্টাসিড সেবন করা উচিত নয়। বুকের ব্যথ্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় ও বাম বাহুতে চলে আসে এবং ব্যায়াম করার সময় বৃদ্ধি পায়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার কারণসমূহ
এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে গ্যাস্ট্রো ইজোফ্যাকাল রিফ্লেক্স ডিজিজ (Gastroesophageal Reflux Disease) বা সংক্ষেপে গার্ড (GERD) কে দায়ী করা হয়। মাঝে মাঝে কিছু তরল পদার্থ পাকস্থলী থেকে গলনালী দিয়ে মুখে চলে আসে, অর্থাৎ উল্টা পথে ধাবিত হয়, একেই বলা হয় Gastro esophageal reflux.  চিকিৎসা বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের গবেষণায় বুক জ্বালাপোড়ার বিভিন্ন কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে।
এগুলো হচ্ছেঃ
ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া।
বুক জ্বালাপোড়ার আরও একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ধুমপান করা।
অ্যালকোহল সেবন বা মদ্য পান করা।
অতিরিক্ত মাত্রায় চা, কফি ইত্যাদি পান করা।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকা অনেক সময় বুক জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী।
কালো গোল মরিচ, সিরকা যুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
আচার, টমেটোর সস, কমলার রস, পেয়াজ, পিপারমেন্ট ইত্যাদি খাবার অনেক সময় বুক জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী।
পিত্ত থলিতে পাথর থাকলেও বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে।
এছাড়া পাকস্থলীর উপর চাপ পড়ে এমন কাজ যেমন এক সাথে বেশি পরিমাণ খাওয়া, স্থুলতা, গর্ভাবস্থা, শক্ত ও মোটা বেল্টের প্যান্ট পড়া ইত্যাদি কারণেও বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে।

বুক ও গলা জ্বালাপোড়ার লক্ষণসমূহঃ
অনেকেরই প্রায়ই বুকে জ্বালাপোড়া হয়ে থাকে। তবে কিভাবে বুঝবেন আপনি বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগছেন। নিম্নে বুক জ্বালাপোড়ার বিভিন্ন লক্ষণসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
পেটের উপরের দিকে মৃদু ব্যথ্যা অনুভূত হওয়া।
বুকের ব্যথ্যার সাথে জ্বালা জ্বালা ভাব থাকা।
কারও কারও বুক জ্বালা খালি পেটে আবার কারও খাবার গ্রহণের পরে হয়।
বুক জ্বালা পোড়া হওয়ার মাঝে মাঝে ঢেকুর উঠতে পারে।
পাকস্থলীর এসিড সম্প্রসারিত হয়ে খাদ্যনালীর উপর পর্যন্ত চলে আসলে বুকে ব্যথ্যা ও জ্বালা হতে পারে। এই ব্যতা ও জ্বালা কখনও স্বল্পস্থায়ী আবার কখনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
বিশ্রামের সময় বুক জ্বালাপোড়া ও ব্যাথ্যার বৃদ্ধি হয়। শুয়ে থাকা বা আধো শোয়া অবস্থায় এসিড খাদ্যনালী দিয়ে উপরে উঠে আসে। ফলে বুক জ্বালাপোড়া হয়। যখন সোজা হয়ে বসে থাকা হয় তখন মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে খাদ্যবস্তুসমুহ পাকস্থলীতে থাকে, তাই বুক জ্বালাপোড়া কম হয়।
বুক জ্বালা পোড়ায় মুখে তিতা স্বাদ অনুভুত হতে পারে বিশেষ করে সকালের দিকে বেশি ঘটে থাকে।
স্বরভঙ্গ বুক জ্বালপোড়ার একটি অস্বাভাবিক লক্ষণ। অম্ল বা এসিড পাকস্থলি থেকে গলা পর্যন্ত উঠে আসলে এরকম হতে পারে। আর এই এসিড কন্ঠস্বরকে ভারি করে তোলে ও স্বরভঙ্গ হয়ে থাকে ।
বুক ও গলা জ্বালার সাথে গলায় ক্ষত হতে পারে, মনে হয় যেন গলা ছিড়ে গেছে। এসিডের কারণে এমনটি হয়। তাই খাবার গ্রহণের পরপর এ রকম হলে বুঝতে হবে এটা বুক জ্বালাপোড়ার সাথে সম্পৃক্ত।
বুক জ্বালা পোড়া হওয়ার সাথে বমিবমি ভাব ও বমি হতে পারে।
দীর্ঘ দিন যাবৎ বুক জ্বালাপোড়া চলতে থাকলে এসিডের কারণে খাদ্যনালী সংকুচিত হয়ে খাবার গিলতে কষ্ট হতে পারে।
বুক জ্বালাপোড়া প্রতিরোধের উপায়:
একটি কথা প্রচলিত আছে যে, Prevention is batter then cure অর্থাৎ রোগ হওয়ার আগেই সচেতন হওয়া ভাল। তবে অবস্থা খারাপ হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে। ঔষধ ব্যতীত বুক জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার।
নিয়মগুলো হলোঃ
যেসব খাবার খেলে বা পানীয় পান করলে বুক জ্বলা-পোড়া করে, সেগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব খাবারের মধ্যে থাকতে পারে টমেটো, কমলালেবু, লেবু, রসুন, পেঁয়াজ, চকলেট, কফি, চা কিংবা কোমল পানীয়।
ভাজা মাংসের পরিবর্তে সেঁকা অথবা ঝলসানো মাংস খাওয়া, কম তেল-চর্বিযুক্ত ও মসলাযুক্ত খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
একসাথে বেশি পরিমাণে না খেয়ে কিছুক্ষণ (২ ঘণ্টা) পরপর অল্প অল্প করে খেতে হবে। ফলে খাবার দ্রুত হজম হবে এবং পেটে অতিরিক্ত গ্যাস ও এসিড উৎপন্ন হবে না।
খাওয়ার পরপর শুয়ে পড়া যাবেনা। অন্তত ১ ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপর ঘুমুতে যাওয়া উচিত।
ঘুমানোর সময় বিছানা থেকে মাথাকে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি উচুতে রেখে শয়ন করতে হবে।
অবশ্যই ধুমপান বর্জন করতে হবে।
শরীরের বাড়তি ওজন থাকলে তা কমিয়ে ফেলতে হবে।
মোটা বেল্টের প্যান্ট না পরে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে।  
অবশ্যই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে।
আমাদের এই যান্ত্রিক জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে ছোট বড় অনেক সমস্যা। তার মধ্যে একটি হলো বুক জ্বালাপোড়া বা Heart burn। অনেকের বুক জ্বালা-পোড়ার মতো সমস্যা হতে পারে কোনো রকম শারীরিক কারণ ছাড়াই। এ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সবচেয়ে বড় চিকিৎসক হয়ে উঠতে হবে নিজেকেই।এজন্য নিজেকে দুশ্চিন্তা ও চাপমুক্ত থাকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর নিয়মাবলি মেনে জীবন যাপন করতে হবে।   

ঘরোয়া উপায়ে গলা-বুক জ্বালাপোড়া দূর করার উপায়ঃ
অনেকের কিছু খেলেই বুক জ্বালাপোড়া করে। এজন্য কেউ কেউ ঔষধও খেয়ে থাকেন। কিন্তু কিছু ঘরোয়া উপায় আছে যা যথাযথভাবে পালন করলে সহজেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস, গা-গুলানো, বুক জ্বালা, ডায়রিয়ার মতো সমস্যায় ভোগেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে ভেবে দেখা দরকার যে, এই সমস্যার মূলে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন বা উল্টোপাল্টা খাওয়ার বাজে অভ্যেস আছে কিনা। খাওয়ার সময়ে ঠিকভাবে বসা, খাবার ভালো করে চিবিয়ে খাওয়া, খাওয়ার পর অন্ততঃ আধ ঘণ্টা সোজা হয়ে বসে থাকা এগুলো মেনে চললে পেটের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সচেতন হতে হবে। প্রসেস খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যার মধ্যে ফাইবার আছে এবং যেটা হজম করা সোজা সেই ধরনের খাবার খেতে হবে।
খাবারে ফাইবার থাকলে সেটা হজম করতে সুবিধা হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেন খাবারে থাকে। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যদি খাবারে থাকে তাহলে যে সব পুষ্টিদ্রব্য ফ্যাটে দ্রবীভূত হতে পারে, সেগুলো শরীর চট করে গ্রহণ করতে পারবে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খাবারে থাকলে সেটা পেটের জ্বালাজ্বালা ভাব কমায়। ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল সমস্যা এতে কম হয়।
প্রচুর পানি পান করতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার অন্যতম কারণ হল পানি কম পান করা। চা, কফি পান যতটা সম্ভব কম করতে হবে। বেশি করে পানি পান করতে হবে সারাদিন। আর তার সঙ্গে যে সব ফল ও সবজিতে পানি থাকে সেগুলোও খেতে হবে।
খাওয়ার সময়ে ভেবে দেখতে হবে কী খাচ্ছেন, কেন খাচ্ছেন। ধীরে ধীরে খেলে খাবার ভালোভাবে হজম হয় এবং গ্যাস ও বদহজম কমে যায়।
ভালো করে চিবিয়ে খেলে খাবার হজম হয় দ্রুত। এছাড়া ধীরে খেলে যে স্যালাইভা নিঃসৃত হয় সেটা পেটের মধ্যে খাবার হজমে সাহায্য করে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করলে হজমের সমস্যা কম হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্যান্য সমস্যাও কমে যায়।

ভারতের বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, অঞ্চলভেদে এই রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতি ১০০ জনে ৮ থেকে ২৯ জন। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, জার্ড অথবা বুক জ্বালাপোড়ার প্রকোপ প্রতি ১০০ জনে ৬ থেকে ২৫ জনে পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার তিনটি গ্রামে সাড়ে তিন হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত সমীক্ষার ফলাফল আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০০ জনে প্রায় ২৫ জন বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগে থাকেন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বুক জ্বালাপোড়া হয়, এমন লোকের সংখ্যা প্রতি ১০০ জনে ১৪ জন।

গত চার দশকে বাংলাদেশের বাড়তি ওজন ও মেদবহুল লোকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ১৯৭৫ সালে বেশি ওজন অথবা মোটা লোকের সংখ্যার হার ছিল প্রতি ১০০ জনে ৫ জন। এখন এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে আমাদের দেশে জার্ড অথবা বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গ্যাস্ট্রো বলতে আমরা পাকস্থলীকে বুঝে থাকি। ইসোফেগাস হচ্ছে খাদ্যনালি। আমাদের শরীরের নিজস্ব কিছু ডিফেন্স মেকানিজম প্রক্রিয়া আছে, যার মাধ্যমে সাধারণতঃ পাকস্থলীর তীব্র দাহ্য পদার্থ ওপরে উঠতে পারে না। এটাকে অ্যান্টি–রিফ্লাক্স মেকানিজম বলা হয়। যদি কখনো কোনো কারণে এ অ্যান্টি–রিফ্লাক্স মেকানিজম কাজ করতে অপারগ হয়, তখন সে তার মূল কাজ পাকস্থলীর অ্যাসিডকে ওপরে যেতে বাধা দিতে পারে না।
এর ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিড ওপরে উঠে আসে। এই অ্যাসিড ওপরে ওঠার জন্য খাদ্যনালিতে অ্যাসিডের দহন এসে লাগে। তার ফলে উপসর্গ দেখা দেয়। এটা হচ্ছে মূল কারণ। ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। এই রোগের ডায়াগনোসিস করার জন্য বিশেষ কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না।
এই রোগের চিকিৎসা না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। মূল জটিলতা হলো খাদ্যনালিতে ঘা বা ক্ষত হতে পারে, যেটাকে আমরা আলসার বলি। দীর্ঘ মেয়াদে এটা খাদ্যনালির নিচের অংশে একধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে, যা থেকে ক্যানসারও হতে পারে।
যেকোনো জনগোষ্ঠীর প্রায় এক–পঞ্চমাংশ বুকজ্বালা রোগে ভুগে থাকে। সংগত কারণেই সবার মধ্যে এর পরিত্রাণের জন্য নিজ থেকে ঔষধ খেয়ে কোনোভাবে ম্যানেজ করার একটা প্রবণতা কাজ করে। কোনো দেশের একটা জনগোষ্ঠী নিজে থেকেই এর ঔষধ খেয়ে থাকে। সে জন্য কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, এটা জানা জরুরি। খাদ্যনালি বুকের ভেতর কিছু সংবেদনশীল অঙ্গের কাছাকাছি অবস্থান করে। এর মধ্যে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড রয়েছে। এ জায়গার স্নায়বিক সংযুক্তি একই রকম হওয়ার কারণে কিছু উপদ্রব বিভিন্ন অঙ্গের উপদ্রবের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। তাই ভালোভাবে জানা দরকার যে জার্ড নাকি অন্য কিছু। এর কিছু আদর্শ উপসর্গ আছে। যেমন বুকে জ্বালা করা। এ জ্বালা অনেক সময় পাকস্থলী থেকে শুরু হয়ে বুকের ওপরের দিকে উঠে আসে। এ ছাড়া কিছু অপ্রচলিত উপসর্গ আছে। যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, বুকে চাপ চাপ মনে হওয়া। তবে সেটা জার্ড না হয়ে আবার হার্টের রোগও হতে পারে। এ জন্য এর যথাযথ রোগ নির্ণয় প্রয়োজন।
এ জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখবেন জার্ড না অন্য রোগ। বয়স্কদের ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক বা হার্টের কিছু টেস্ট করে নেওয়া প্রয়োজন হয়। আর যাঁদের দীর্ঘদিন ঔষধ গ্রহণ করে কাজ হচ্ছে না, তাঁদের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। পরীক্ষার মধ্যে কমন হচ্ছে এন্ডোসকপি। এর মাধ্যমে খাদ্যনালি ও পাকস্থলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পশ্চিমা বিশ্বে- এর প্রভাব বেশি। শহরাঞ্চলেও এর প্রভাব বেশি। এতেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের জীবনযাত্রা, আচরণগত ব্যাপার বা খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এটার একটা যোগাযোগ আছে। চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, ধূমপান, মদ্যপান চা-কফি ইত্যাদি খাবার বুক ও গলা জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার যেটাতে সমস্যা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মধ্যে স্থূলতা একটা বড় বিষয়। এটা কমাতে পারলে জার্ড অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে পারি। একসঙ্গে পাকস্থলীর ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি খেয়ে ফেললে খাবার ওপরের দিকে উঠে আসে। এ অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। একবারে বেশি খাব না। খাবার পর অন্তত দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে শোব না। এরপরও এ সমস্যায় ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আমাদের দেশে এ রোগের জন্য একটি ইনস্টিটিউট আছে। যেখানে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। অন্যদিকে এই চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দেশে বিশ্বমানের ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরগুলোই মূলত গলা ও বুক জ্বালাপোড়ায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যেও ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসাব্যবস্থায় ইসোমিপ্রাজল পিপিআই বহুলাংশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোনো একটা ট্যাবলেট দীর্ঘদিন ব্যবহার হলে তখন দেখা গেল এটার ইফেক্ট আছে। একটা সিঙ্গেল ট্যাবলেটের চারদিকে কোটিং থাকে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে দেখা গেল এতে কিছু ড্রাগ লস হয়। ফলে যে উপকার পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যায় না। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ওষুধ হচ্ছে মাল্টি ইউনিট প্যালেট সিস্টেম (মাপস)। অসংখ্য মাইক্রোপ্যালেটস দিয়ে তৈরি হয়। এখানে ৪০০ থেকে ৬০০ মাইক্রোপ্যালেটস ব্যবহার করায় সারফেস এরিয়া বেড়ে যায়। মাইক্রোপ্যালেটস হওয়ায় ড্রাগ লস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তেমনি দ্রুত অন্ত্রে পৌঁছায়। চিকিৎসকের পরামর্শে এটা ব্যবহার করা যায়।
বর্তমানে বুক জ্বালাপোড়া একটি সাধারণ সমস্যা। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন সচেতনতা নেই। সে জন্য এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা আমাদের দায়িত্ব। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া ঔষধ হয় না। ঔষধ না খাওয়ার প্রতিক্রিয়া ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চেয়ে বেশি। এ রোগের ওষুধের তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটা ব্যবহারে উপশম হয় বেশি। এসব বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে প্রায় ২০০ জনের মতো গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি রোগি আছেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *