চার্লি চ্যাপলিন

 

পৃথিবীর  সফল মানুষের ব্যর্থতার কাহিনীঃ

চার্লি চ্যাপলিন: বুকে কষ্ট চেপে দর্শকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন যে মহান অভিনেতা

পরনে জরাজীর্ণ কোট-টাই, ঢিলেঢালা মলিন প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের ডার্বি হ্যাট, হাতে একটি ছড়ি, পায়ে পুরোনো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের উপর খাটো অথচ প্রশস্ত একটুখানি টুথব্রাশ গোঁফ – এই লোকটাকে কে না চেনে! তিনি আমাদের সকলের প্রিয় মূকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। 

এক শতাব্দী পূর্বে তাঁর অমর কাজগুলো আজকের দিনেও আমাদের বিনোদনের খোরাক জোগায়, হাসি ফুটিয়ে তোলে আজও আমাদের মুখে । সর্বকালের সেরা ও সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের তালিকা করা হলে নিঃসন্দেহে চার্লি চ্যাপলিনের নাম একদম উপরের দিকেই থাকবে বিশ্বের ইতিহাসে। 

চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সেই ‘ভবঘুরে’ বেশভূষা; Image Source: Biography.com

শৈশব: শুরুটাই যেখানে সংগ্রাম দিয়ে। 

চার্লি চ্যাপলিনের প্রকৃত নাম ‘চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন’।

 যদিও  তাঁকে  ডাকা হয় বিশ্বব্যাপী ‘শার্লট’, ’কার্লিটোস’, ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প (ভবঘুরে)’ ইত্যাদি নামেও । তার জন্মতারিখ ও জন্মস্থান নির্ভুলভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। 

তবে ধারণা করা হয়, তিনি ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালউওর্থে জন্মগ্রহণ করেন। চার্লি চ্যাপলিন ব্রিটেনেই জন্মগ্রহণ করেছেন অবশ্য তাঁর মৃত্যুর অনেক পর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি  ।

 তাঁর জন্মস্থান, এমনকি ফ্রান্সও হতে পারে বলে অনুমান করা হয়! আবার,  ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ড- শায়ারের একটি ক্যারাভ্যানে তিনি ভূমিষ্ঠ হন ২০১১ সালে উদ্ধারকৃত একটি পুরোনো চিঠিতে পাওয়া তথ্যমতে।

চার্লি চ্যাপলিনের বাবা ছিলেন ‘চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র’ এবং তাঁর মায়ের নাম ‘হানাহ চ্যাপলিন’। তারা দুজনই একাধারে অভিনয় করতেন এবং পাশাপাশি গানও গাইতেন মঞ্চে।

চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্টের মাঝে চার্লি চ্যাপলিনের শৈশব কেটেছে । বারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, অনেক মানুষকে পুরো জীবদ্দশাতেও সেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় না।

 তাঁর বয়স তিন বছর হওয়ার পূর্বেই তাঁর বাবা-মা আলাদা বসবাস করা শুরু করেন ; যদিও তাঁদের  মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি। 

তার সৎ বড় ভাই ‘সিডনি চ্যাপলিন’ সাথে ছিলো কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই তার মা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হলে চ্যাপলিন অসহায় হয়ে পড়ে।

 তাঁর ভরণপোষণ ও দেখাশোনার দায়িত্বে কেউ না থাকায় তাঁকে প্রাথমিকভাবে লন্ডনের একটি অনাথাশ্রমে এবং পরবর্তীকালে অসহায় ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য তৈরি ‘সেন্ট্রাল লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট স্কুল’-এ পাঠানো হয়। তাঁর বয়স তখন মাত্র সাত বছর। 

এভাবে প্রায় দুই বছর ঘরের বাইরে কাটানোর পর অল্প সময়ের জন্য চ্যাপলিন পুনরায় তাঁর মায়ের দেখা পান। তবে সেটা বেশি দিনের জন্য নয় । কারণ তার মা তখনো সুস্থ হয়ে ওঠেননি।

প্রকৃত পক্ষে তাঁর- চার্লি চ্যাপলিনের মা হানাহ চ্যাপলিন আর কোন দিন সুস্থ হয়ে উঠেননি । মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। এরপর চ্যাপলিনকে কিছুদিনের জন্য তাঁর বাবার কাছে পাঠানো হয়, যিনি তখন ছিলেন মদ্যপ। 

সেখানে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি বালক চ্যাপলিনের। বাবা-মা দুজনের পেশাই মঞ্চের সাথে জড়িত হওয়ার সুবাদে চার্লি চ্যাপলিন নিজেও এদিকটায় ঝোঁকেন। 

অভাবের তাড়নায় ও মঞ্চে অভিনয় করার আগ্রহ থেকে মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি যুক্ত হন ‘দ্য এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’ নামক একটি যাত্রাদলের সাথে, যার সদস্যরা সবাই ছিলো অল্পবয়সী।

মূলতঃ এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় এবং প্রথম থেকেই বালক চার্লি চ্যাপলিনের মঞ্চাভিনয় দর্শক ও আয়োজকদের নজর কাড়তে শুরু করেন। 

এরপর চ্যাপলিন ছোটখাট আরও নানা মঞ্চে, নানা প্লাটফর্মে অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করে সুনাম কুড়াতে থাকেন। ফলস্বরূপ তার পরবর্তী জীবনে তৎকালের কিছু নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিনয় ও চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। 

শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন ও কর্মব্যস্ত এক অধ্যায়। এরপর চার্লি চ্যাপলিন নামক এই দুঃখী বালকটিকে অন্তত অর্থ-কড়ির ব্যাপারে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ।

ব্যক্তিগত জীবনঃ

শৈশবে কঠোর সংগ্রাম করে পরবর্তীতে বিশ্বমঞ্চে সেরাদের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া চার্লি চ্যাপলিন সারাটা জীবন ‘সুখ পাখি’র পেছনে দৌড়ে গেছেন, কিন্তু সেই পাখির নাগাল পাননি কখনোই। 

জীবন তাঁর জন্য সবসময়ই বয়ে এনেছে দুঃখ আর কষ্ট। গগনচুম্বী খ্যাতির সাথে সাথে তার কপালে অনেক অপবাদও জুটেছে । 

শৈশবের দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে এসে যখন তিনি খ্যাতির সিংহাসনে আরোহণ করছিলেন, তখন কিছু বিতর্কিত কান্ডকারখানাও ঘটিয়েছিলেন, যা তার ক্যারিয়ারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিলো।

চলচ্চিত্র ও জীবন-দর্শনঃ

তীব্র বেদনাদায়ক শৈশব চার্লি চ্যাপলিনকে জীবন সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলো। চার্লি নিজেকে নিয়ে ভাবতেন, নিজের চারপাশের মানুষ নিয়ে ভাবতেন এবং সমাজকে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। 

সমাজ সম্পর্কে তাঁর দর্শন ছিলো অতি সাধারণ। অথচ তার পর্যবেক্ষণ ছিলো অত্যন্ত গভীর। চার্লির জীবন সম্পর্কে জানলে দেখা যায়, তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, জীবনদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছে।

তাঁর সর্বপ্রথম সন্তানটি জন্মের পর বেঁচে ছিলো মাত্র তিনদিন। তাঁর প্রথম সন্তানের মৃত্যুর দুই বছর পরই মুক্তি পায় ‘দ্য কিড’ চলচ্চিত্রটি। যেখানে দারিদ্র্য, বাবা-মা’র বিচ্ছেদ ও এক শিশুর অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়। 

স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকেই অনুধাবন করে নেওয়া যায়, এই চলচ্চিত্রটির অণুপ্রেরণা চার্লির শৈশব ও পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেওয়া তাঁর সন্তানের স্মৃতি থেকেই এসেছে।

দ্য কিড এর একটি দৃশ্যে চার্লি চ্যাপলিনের সাথে শিশু অভিনয় শিল্পী জ্যাকি কুগান। চলচ্চিত্রটি যেন চার্লির শৈশব ও অকালপ্রয়াত শিশু সন্তান ‘নরম্যান চ্যাপলিন’ এর অনুপস্থিত সত্ত্বাকেই উপস্থাপন করে; 

চার্লি বড় হয়েছেন তীব্র অভাব অনটনের মাঝে। 

তাই তাঁর প্রথমদিকের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে সমাজের সবচেয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণীটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এবং তাঁর চলচ্চিত্রে এরা বারবার চিত্রায়িত হয়েছে। ‘এ ডগস লাইফ’, ‘মডার্ন টাইমস’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রেও তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারার প্রতিফলন সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয়।

পেশাগত জীবনঃ

মাত্র আট বছর বয়সে কর্মজীবনে প্রবেশ করে চ্যাপলিন যখন একের পর এক অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিচ্ছিলেন, তখনও তাঁর  আর্থিক দুর্দশা পুরোপুরি কাটেনি; কেবল কোনো রকম জীবিকা নির্বাহ করার মতো ব্যবস্থা হয়েছিলো মাত্র।

 তাই তিনি হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলেন। তিনি যেহেতু অভিনয় পছন্দ করতেন, তাই তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিলো অভিনয় সংক্রান্ত কোনো একটি পেশা বেছে নেওয়া।

চার্লি চ্যাপলিন যখন তরুণঃ

কর্মজীবনে প্রবেশের দীর্ঘদিন পর, অনেক চড়াই- উতরাই পেরিয়ে ১৯০৮ সালে তিনি সেরকম একটি সুযোগ পেয়ে যান। তাঁর বয়স যখন আঠারো পেরিয়েছে, তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি তখন ঘটে; ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’তে তিনি যোগদান করেন। 

তখনকার দিনে ব্রিটেনের এই স্বনামধন্য কোম্পানিটি হাস্যরসাত্মক নাটক তৈরি করতো ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর প্রদর্শনী করে বেড়াতো। 

এই কোম্পানিতে যোগদান চ্যাপলিনকে একটি বড় সুযোগ এনে দেয় নিজেকে প্রমাণ করার ও বিশ্ব বাসীর সামনে নিজেকে মেলে ধরার, যা তিনি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন।

তাঁর অসাধারণ স্টেজ পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে ১৯১০ সালে তাকে মঞ্চনাট্য প্রদর্শনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করে ‘দ্য কার্নো কোম্পানি’। 

প্রায় দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে নিজের অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শন করার পর তিনি ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। তবে এর কয়েক মাস পরই আবারও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয় তাঁকে ।

চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম চলচ্চিত্র Making a living এর একটি দৃশ্য; Image Source: Youtube Channel – Chaplin Movies

এবার ভাগ্য তার দিকে মুখ তুলে তাকালো; 

যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চ্যাপলিনকে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। অনেক ভেবেচিন্তে চ্যাপলিন ‘কিস্টোন স্টুডিও’তে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। 

তাঁর সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছিলো ১৫০ ডলার। এই স্টুডিওর অধীনেই তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেকিং এ লিভিং’ (১৯১৪) মুক্তি পায়, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন চ্যাপলিন নিজে।

আমি বিশ্বাস করি, যেদিন আমি কোনো কাজ করবো না, সেদিনের রাতের খাবারটা আমার প্রাপ্য নয়।

–চার্লি চ্যাপলিন

চার্লি তার কাজকে ভালোবাসতেন। দিন দিন তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার পারিশ্রমিকের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগলো; প্রথম তিন বছরে তার পারিশ্রমিক প্রায় দশ গুণের মতো বেড়ে যায়! চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত বেশভূষা ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’ বা ‘ভবঘুরে’ ছিলো জগদ্বিখ্যাত।

 এই বেশভূষার সাহায্যে তিনি নিজেকে এক হাস্যকর চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে পেরছেন। এই চরিত্রটি একইসাথে আবার রাজকীয় ব্যক্তিত্বও প্রদর্শন করতে চায় সবখানে, তবে পদে পদে অপদস্থ হয়, যা তাকে আরও হাস্যকর করে তোলে।

প্রথমদিকে, তিনি অন্যান্য পরিচালকদের পরিচালনায় অভিনয় করলেও পরবর্তীতে পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করতে থাকেন। 

ফলস্বরূপ, চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তাঁর পরবর্তী চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করার সময় তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতেন –

পারিশ্রমিকঃ

 তিনি তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি আশা করতেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাঁর কাজের উপযুক্ত মূল্যায়ন করবে।

পরিচালনার দায়িত্ব:

তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তাই নিজেই পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতেন।

সময়: 

চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন ‘পারফেকশনিস্ট’। কাজের গুণগত মান তাঁর কাছে মুখ্য ছিলো। সেজন্য তিনি তাড়াহুড়া না করার জন্য উপযুক্ত সময় চাইতেন।

এসব শর্ত বজায় রেখে তিনি একের পর এক স্বনামধন্য চলচ্চিত্র-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিবদ্ধ হতে থাকলেন। 

তিনি কাউকে হতাশ করেননি; একের পর এক মাস্টারপিস তাঁর হাত ধরে বের হতে লাগলো। তিনি তখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম।

চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা ও তার কাজের গুণগত মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য একটি তথ্যঃ

তিনি মার্কিন চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের মাত্র তিন বছর পর, ১৯১৬ সালে ‘দ্য মিউচুয়াল ফিল্ম কর্পোরেশন’ এর সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। 

যার শর্ত হলো, চার্লি চ্যাপলিন নিজের ইচ্ছামতো ১২টি চলচ্চিত্র তৈরি করে দেবেন এবং বিনিময়ে কাজ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত তৎকালীন মুদ্রায় বার্ষিক ‘ছয় লক্ষ সত্তর হাজার’ মার্কিন ডলার করে পাবেন! তিনি আঠারো মাসে চুক্তির শর্ত পূরণ করেন এবং মিউচুয়াল কর্পোরেশনকে উপহার দেন ১২টি মাস্টারপিস চলচ্চিত্র।

The Gold Rush চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের একটি দৃশ্য। চ্যাপলিন নিজেই তখন নিজের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন; Image Source: vikielester.com

এরপর তিনি ‘ফার্স্ট ন্যাশনাল’ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন, তখন তাদের সহায়তায় নিজস্ব স্টুডিও তৈরি করেন চ্যাপলিন এবং আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করেন।

 উল্লেখ্য, তাঁর কাজের মান ও সময় দিন দিন বাড়তেই থাকে। এটাই ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় বাইরের কোনো কোম্পানির অধীনে তাঁর করা সর্বশেষ কাজ। তিনি সহসাই অনুধাবন করলেন, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন এবং সে সামর্থ্যও তার ছিলো। 

অবশেষে ১৯১৯ সালে চার্লি চ্যাপলিন আরও কয়েকজন অংশীদারকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেন ‘ইউনাইটেড আর্টিস্টস’ নামক চলচ্চিত্র-নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। 

তাঁর পরবর্তী কাজগুলো এর অধীনেই হয়েছিলো। সারা বিশ্বব্যাপী চার্লি চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে ছিলো।

চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলোর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে তাঁর বাকি সবগুলোই নির্বাক কমেডি চলচ্চিত্র। 

তিনি মূলতঃ হাস্যরসাত্মক ঘঠনার সিনেমা বানালেও, পরবর্তীতে তাঁর চলচ্চিত্রে অন্যান্য মাত্রা যেমন ট্রাজেডি, রোম্যান্স ইত্যাদি যোগ হতে থাকে। 

তিনি যখন আমেরিকা থেকে ফিরে পুনরায় ইউরোপে বসবাস শুরু করেন, তখন উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারেননি।

 ইউরোপ চলে আসার পর তিনি মাত্র দুটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন- ‘এ কিং ইন নিউইয়র্ক’ ও ‘এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’।

চার্লি চ্যাপলিনের একটি বিশেষ কৃতিত্ব হলো, তিনি অভিনয় শিল্পকে রাতারাতি থিয়েটারের মঞ্চ থেকে টেলিভিশনের পর্দায় নিয়ে এসে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। এর জন্য তিনি বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিতর্ক ও স্বেচ্ছা-নির্বাসনঃ

ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, চার্লি তার চলচ্চিত্রে নিজের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর জীবনদর্শনে রাজনীতিও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তিনি জীবন থেকে রাজনীতিকে আলাদা করতে পারতেন না। 

তাঁর বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের কারণে তিনি বেশ বিতর্কিত হয়েছেন। সমালোচনার বানে জর্জরিত হয়েছেন বহুবার। ক্ষেত্রবিশেষে তাকে কখনো কখনো দুর্দশা বরণ করতে হয়েছিলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁকে নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক সমালোচনা শুরু হয় । তিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় ব্রিটেনব্যাপী তীব্র সমালোচনা করা হয় তাঁর। তিনি নিজের মাতৃভূমির পক্ষে যুদ্ধে যোগ না দেওয়ায় তাঁকে কাপুরুষ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁকে এক প্রকার তুলা ধুনো করেই ছেড়ে ছিলো। এরপর আবার ১৯৩৬ সালে তিনি শিরোনাম হন ‘মডার্ন টাইমস’ প্রকাশিত হওয়ার পর।

১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিলো এই মাস্টারপিস চলচ্চিত্রটি। এতে তিনি বেকারত্বের উপর শিল্পায়নের প্রভাব তুলে ধরেন এবং পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন। 

আমেরিকানরা এতে রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পায় এবং চলচ্চিত্রকার হিসেবে তিনি রাজনৈতিক সমালোচনার শিকার হন। একইসাথে তিনি রাজনীতি বিদদের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হন। মোটামুটি তখন থেকে তিনি রাজনীতি বিদ ও গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।

Modern Times এ চার্লি চ্যাপলিনঃ

১৯৪০ সালে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি অ্যাডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। কিন্তু মার্কিনীরা এতে ‘বামপন্থা’ খুঁজে পান এবং তাঁর দিকে অভিযোগের তীর আরও দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ হয়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে চার্লি চ্যাপলিন নানাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করেন। এতে কম্যুনিজমের পক্ষে তাঁর অবস্থান আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতদিন পর মার্কিন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, তারা অনুধাবন করতে পারে চার্লি চ্যাপলিনের পূর্বের চলচ্চিত্রগুলো, যেগুলোতে শোষিত শ্রেণীর দুর্দশা তুলে ধরা হয়েছে, সমাজের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষজনদের উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে, সেগুলোতেও ‘সমাজতন্ত্রের উপাদান’ নিহিত আছে।

তদুপরি, তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।

দিন দিন মার্কিন সমাজে চ্যাপলিনকে বয়কট করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং রাজনীতি বিদরা তাঁকে কোনো প্রকারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করার জন্য বাহানা খুঁজতে থাকেন। অবশেষে ১৯৫২ সালে সেই সুযোগ আসে।

The Great Dictator এর একটি দৃশ্যে একনায়কের রূপে চার্লি চ্যাপলিন। এডলফ হিটলারের সাথে তাঁর এই বেশভূষার বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।  চার্লি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হতে চলেছে। আর তাঁর জন্য তিনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্কিন সমাজে তাঁর  প্রতি তৈরি হওয়া বিদ্বেষী মনোভাব তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। 

তাঁর শৈশব এবং আমেরিকায় তাঁর  ক্যারিয়ার ও জন প্রিয়তার উত্থান-পতনের উপর আলোক পাত করে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য লাইমলাইট’ ১৯৫২ সালে মুক্তি পায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এটি আমেরিকায় মুক্তি না দিয়ে ইংল্যান্ডে মুক্তি দেবেন। এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

এর পরপরই ‘এফবিআই’ এর তরফ থেকে তাঁকে জানানো হলো, তিনি পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে চাইলে তাকে জেরার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। 

চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন অভিমানী। তাই যুক্তরাষ্ট্রে ফেরা হয়নি তাঁর। তবে ধারণা করা হয়, তিনি আবেদন করলেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার হয়তো তাঁকে পুনরায় প্রবেশাধিকার দিতো। কিন্তু তিনি তার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। অবশ্য এ ঘটনার ২০ বছর পর তিনি বিশেষ সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন।

নাটকীয় জীবনের শেষভাগঃ

একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রতিভা সাধারণতঃ একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। একাধিক কাজে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যান। চার্লি চ্যাপলিন নিজে তাঁর চলচ্চিত্র একাধারে পরিচালনা, অভিনয় ও অর্থায়ন করতেন এবং সেগুলোতে ব্যবহৃত গান বা সুর তিনি নিজেই রচনা করতেন। এই কাজগুলোর প্রত্যেকটিতেই তিনি উন্নত রুচির পরিচয় দিয়েছেন।

তাঁর জীবনী থেকে আমরা একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের শিক্ষা পাই। প্রাচুর্য ও সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেও তিনি তার শৈশবের স্মৃতিকে ভুলে যাননি। 

এজন্য প্রচুর অর্থ বিত্তের মাঝে থেকেও তিনি বিলাসীতায় গা ভাসিয়ে দেননি। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি হাল ছেড়ে দেননি, জীবনকে তিনি ইতিবাচক ভাবে নিয়েছেন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন।

চার্লি চ্যাপলিন নিজের উপর তাঁর এতই বিশ্বাস ছিলো যে, তিনি নিজের চলচ্চিত্রের যাবতীয় কাজ এককভাবে নিজেই সম্পাদন করে সেই চলচ্চিত্রকে সাফল্য মন্ডিত করে দেখিয়েছেন।

উওনার সাথে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া চার্লি চ্যাপলিনঃ

তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন, তার মা’ই তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। এর প্রমাণ চার্লি দিয়েছেন; আমেরিকায় যখন তিনি আর্থিক সচ্ছলতার দেখা পেলেন, তখন তাঁর মাকে ব্রিটেন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যান। মায়ের মৃত্যুর আগপর্যন্ত চার্লি চ্যাপলিন তাকে অপরিসীম মমতা ও যত্নে আগলে রেখে ছিলেন; কোনো কষ্ট তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে চলে আসার পর চার্লি চ্যাপলিন সুইজারল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ১৯৭৭ সালের বড়দিনে এই অবিস্মরণীয় মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে।

চার্লি চ্যাপলিনের জীবন বদলে দেওয়া কিছু কথা

চ্যাপলিন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা। চ্যাপলিনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলে মনে করা হয়। 

১. প্রতিটা শিশুর মধ্যে প্রতিভা আছে, কিন্তু তার ভেতর থেকে সেটা বের করে আনতে জানতে হয়।

২. জীবন অনেক সুন্দর, যদি তুমি ভয় না পাও।

৩. আয়না হচ্ছে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, কারণ যখন আমি কাঁদি সে তখন হাসে না।

৪. নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলে তুমি কখনো রংধনু খুঁজে পাবে না।

৫. হাসি হলো ওষুধ, যা দুঃখ থেকে মুক্তি দেয়।

৬. হাসি ছাড়া একটি দিন মানে সেই দিনটা নষ্ট।

৭. আমার জীবনে অনেক সমস্যা। কিন্তু আমার ঠোঁট তা জানে না বলে সব সময় হাসতে থাকে।

৮. এই পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়, এমনকি আমাদের সমস্যাগুলোও না।

৯. আমি বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে কেউ আমার অশ্রু দেখতে না পায়।

১০. আমার দুঃখ-কষ্টগুলো কাউকে কাউকে হাসাতে পারে, কিন্তু আমার হাসি যেন কখনই কাউকে দুঃখ না দেয়।

১১. কাছ থেকে দেখলে জীবন হচ্ছে ট্র্যাজিডি, কিন্তু দূর থেকে দেখলে সেটা কমেডি।

১২. আমরা প্রত্যেকেই একে অন্যকে সাহায্য করতে চাই। মানুষ এমনই, আমরা বেঁচে থাকি অন্যদের আনন্দ দিয়ে, দুঃখ দিয়ে নয়।

১৩. মন খুলে হাসতে চাইলে নিজের দুঃখ-যন্ত্রণাগুলোর সঙ্গে খেলতে শেখো।

১৪. ভালোবাসা দাও, ভালোবাসা ছড়াও।

১৫. জীবন অনেক সুন্দর, এমনকি একটা জেলি ফিশের কাছেও।

১৬. সরলতাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

১৭. তুমি কিসের অর্থ খোঁজো? জীবন হলো একটা আকাঙ্ক্ষা, কোনো অর্থ নয়।

১৮. যেদিন আমি ভালো কোনো কাজ করি সেটাই আমার সবচেয়ে সুখের দিন।

১৯. কৌতুক করা অনেক সিরিয়াস একটা ব্যাপার।

২০. আমি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করি না।

২১. আমি হলাম পুরনো আগাছার মতো। আমাকে যতোই কাটবে, ততই আমি বেড়ে উঠবো।

২২. জ্ঞানী হই বা বোকা, আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের সঙ্গে লড়তে হয়।

২৩. আমি যদি কথা বলতাম তাহলে আমি অন্য কৌতুকাভিনেতাদের মতো হয়ে যেতাম।

২৪. সব সত্যের মধ্যেই মিথ্যার একটা বীজ রয়েছে।

২৫. বাস্তবতা দিয়ে চলচ্চিত্র হয় না, চলচ্চিত্র তৈরি হয় কল্পনা দিয়ে।

২৬. আমি রক্ত ঘৃণা করি, অথচ এটা আমার শিরার ভেতরই আছে।

২৭. ধনী হয়ে যাওয়া লোকটাও দারিদ্রতার সময়গুলো নিয়ে স্মৃতিকাতর থাকে, কারণ তখন তার জীবনে স্বাধীনতা ছিলো।

২৮. দিনশেষে সবকিছুই ঠাট্টা।

তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না অনন্ত প্রতিভা সম্পন্ন এই মানুষটি একই সাথে পেশায় ছিলেন অভিনেতা, পরিচালক, সুরকার চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং সম্পাদক সফলতার সকল উঁচু শিখড়ে তার ছিলো সমান বিচরণ।

টিভি ও চলচিত্র জগতের শুরুর দিকের এই মহান অভিনেতার জীবনের বিভিন্ন দিক তার জীবনী ও জীবন সংগ্রামের সব ঘটনা যা আমরা সবসময় জানতে পারিনা সেটাই আপনাদের কাছে তুলে ধরবো ।

Charlie Chaplin এর জন্ম হয়েছিলো 16 April 1889 সালে England এর London শহরে। তাঁর বাবা চার্লস স্পেন্সার্স চ্যাপলিন ও মা হেরা চ্যাপলিন সিনিওর মিউজিক হলের জুনিয়র আর্টিস্ট ও সিঙ্গার ছিলেন।

একবার বিখ্যাত পদাৰ্থ বিজ্ঞনী Sir Albert Einstein চার্লি চ্যাপলিন এর সাথে দেখা হলে বলেছিলেন আমি আপনার খুবই ভক্ত হয়ে গেছি আপনি কোনো কথা না বলেও সবাইকে আপনার মনের কথা কতো সহজেই বুঝিয়ে দেন।

জবাবে চার্লি বলেন হ্যা এটি সত্যি, আপনিও আপনার থিওরী সম্পর্কে এত কিছু বলেন সবাই আপনার কতো প্রশংসা করে কিন্তু দুঃখের কথা এইজে তবু তারা আপনার কথা কেউ বুজতে পারে না।

Charlie Chaplin early লাইফঃ

চার্লি চ্যাপলিন এর প্রথম রোজগার ছিলো মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। যখন তাঁর মা একদিন টাউন হলে গান গাওয়ার সময় গলায় সমস্যা দেখা দেয় ও আওয়াজ বের হচ্ছিলনা দর্শকরা তখন বিরক্ত হয়ে চিৎকার চেচামেচি করেন ও চ্যাপলিনের মাকে মারতে উদ্দতে হন।

ছোট চ্যাপলিন তখন মায়ের বিপদ দেখে স্টেজে উঠে আসেন এবং তাঁর মায়ের গাওয়া গান অভিনয়ের সাথে গাইতে শুরু করেন দর্শকদের তার এই আধো আধো কণ্ঠে গাওয়া গান খুব উপভোগ করেন স্টেজে পয়সার বৃষ্টি শুরু হয়।

বাস্তব জীবনের তাদের গরিব হওয়ার কষ্টও যে অন্যকে স্টেজে আনন্দ দেয় ফানি মনে হয় সেটা তিনি হয়তো তখনি এই ঘটনাতেই বুঝে গেয়েছিলেন। তাইতো পরবর্তীতে তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি গরীবতা, দুঃখ, কষ্ট, একাকীত্ব, বেকারত্বের মতো ঘটনা অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লোককে আনন্দ দেয়ার জন্য।

কষ্ট ও দারিদ্রতায় পরিপূর্ণ ছিলো চার্লি চ্যাপলিনের শৈশব জীবন মাত্র ছয় বছর বয়সে চার্লির বাবা ও মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তখন চার্লি ও তার ভাইকে নিয়ে চার্লির মাকে অনাথ আশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো কারণ তখন চার্লির মায়ের কোনো উপার্জন ছিলনা। দরিদ্রতার দুঃচিন্তায় চার্লির মা কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে পাগলা গারদে চলে যায়।

তখন আদালতের নির্দেশে চার্লি ও তাঁর ভাইকে তাঁর বাবার কাছে থাকতে হতো। চার্লির বাবা তখন আবারো বিবাহ করেছিলেম সৎমায়ের সংসারে তাই চার্লি ভাই এর কষ্টের কোন কমতি ছিলনা। এক বছর পরে চার্লির মা ভালো হয়ে ফিরে আসলে তাঁদের জীবনে আবার প্রাণ ফিরে আসে।

পড়াশোনায় বিশেষ মনোযোগ চার্লির ছিলনা। তিনি অভিনয়কেই তাঁর জীবনের লক্ষ হিসেবে মনে স্থান দিয়েছিলেন। দশ বছরের ও কম বয়স থেকে চার্লি স্টেজশো করতেন ও সাথে অন্য কাজ করতেন উপার্জনের উদ্দেশ্যে তাঁর লক্ষ যেহেতু ছিল অভিনেতা হওয়ার তাই তিনি নিয়মিত ব্ল্যাক মুর থিয়েটার এ যেতেন অভিনয় দেখতে।

চার্লি একদিন যখন স্টেজশো করছিলেন তখন একজন থিয়েটার পরিচালকের নজরে আসেন। চার্লির অভিনয়ের বিষয়বস্তু ও বাস্তবিক রূপায়ণের দক্ষতা তাকে মুগ্ধ করে। 

সেই পরিচালকের মাধ্যমে চার্লির পরিচয় বিখ্যাত পরিচালনা ই হ্যামিলটন এর সাথে হয়। ই হ্যামিলটন তাকে শার্লক হোমস এ অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব রাখেন। শার্লক হোমস সিরিজ এ অভিনয় করে চার্লি খুব পরিচিতি লাভ করে।

১৯১৩ সালে আমেরিকার নামকরা সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান New York Motion Pictures চার্লির সাথে চুক্তি করে। তাঁর পরের বছর ১৯১৪ মুক্তিপায় চার্লি চ্যাপলিনের একক সিনেমা Making A Living, দর্শক মহলে তাঁর অভিনয়ের মুগ্ধতায় পরবর্তীতে আরো অনেক সিনেমায় কাজ করেন।

১৯১৪ সালেই চার্লি প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত ও পরিচালনার সাথে অভিনীত প্রথম সিনেমা হলো Caught in the Rain যা তাকে খুবই জনপ্রিয়তা প্রদান করে এবং তাঁর  জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। একজন অভিনেতা থেকে বিশ্বের জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে যান নিষ্ঠাবান অভিনয়ের জন্য।

বিশ্বের কঠিনতম সময় এর মধ্যে প্রবাহিত তাঁর জীবন বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও মানুষের কষ্টকে হাসির মাধ্যমে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলতেন যে, তাঁর  অভিনয় দেখা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ক্ষনিকের জন্য তাদের দুঃখ কষ্ট ও উপবাসের কথা ভুলে না হেসে থাকতে পারেনি।

চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যুঃ

1977 সালের অক্টোবর থেকেই চ্যাপলিনের শারীরিক অবস্থার প্রচন্ড অবনতি হয়।  তাঁকে বাড়িতেই নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে রাখা হয়, 25 ডিসেম্বর 1977 চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যু হয় ভোর বেলায় ঘুমের মধ্যে। তিনি  হার্ট স্ট্রোক এ আক্রান্ত হয়ে নিজের বাড়িতেই কিংবদন্তি চার্লি  চ্যাপলিনের মৃত্যু হয়।

ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সব থেকে বড় উৎসবের দিন বড়দিনে তার মৃত্যু হলেও তাকে কবর দেয়া হয়  ডিসেম্বরের 27 তারিখে।  ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর এই অন্তিম অনুষ্ঠানটি তাঁর আত্মীয় পরিজন এবং নিকট বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

চার্লি চ্যাপলিন নির্বাক চলচ্চিত্রের এবং চলচ্চিত্র অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের পরিচিতি এতটাই গড়ে তুলেছিলেন যে, তাঁকে চলচ্চিত্র জগতের প্রথম কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে অভিহিত করা যায়।

আর তার এই চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং অবদান-এর মাধ্যমে তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করে ছিলেন । মৃত্যুর সময় তাঁর  পরিবারের জন্য 100 মিলিয়ন ডলারের অধিক সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

সম্পদের লোভে তাঁর কফিনের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে ঘটে যায় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এই ঘটনাটি একটি ভৌতিক ঘটনার চাইতে কোনো ভাবেই কম নয়।

১৯৭৮ সালের ১ লা মার্চ চার্লি চ্যাপলিনের কবর খুঁড়ে তাঁর  কবর থেকে কফিনটি চুরি করে নেয়া হয়, এই ঘটনায় সুইজারল্যান্ড সহ সমস্ত দুনিয়া জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

কফিন চুরির ঘটনাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল চ্যাপলিনের রেখে যাওয়া 100 মিলিয়ন ডলারের সম্পদের থেকে ৬ লক্ষ ডলার কফিনের মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর স্ত্রী উনা চ্যাপলিনের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া,  এজন্য উনা চ্যাপলিন কে ফোন করে হুমকিও দেয়া হয়। 

চার্লি চ্যাপলিনের ভক্তদের সকলকে স্বস্তি দিয়ে তাঁর কফিনটির নিরাপদেই উদ্ধার করা হয় ১৯৭৮ জুলাই মাসে, চ্যাপলিনের কফিনটি নোভিলের কাছে একটি মাঠে সমাহিত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে। এই ঘটনা ঘটানোর জন্য রোমান ওয়ারদাস এবং গ্যানচো গ্যানেভ কে আটক করা হয়। তারাই চ্যাপলিনের কফিনটি চুরি করেছিল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *