দাদ রোগ কীভাবে ছড়ায়

দাদ একটি সংক্রামক রোগ। ইহা ট্রাইকোফাইটন, মাইক্রোস্পোরাম ও এপিডার্মোফাইটন প্রকারের ফাঙ্গাস জাতীয় জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রামণ ঘটায়। ইহা মূলত তিন ভাবে ছড়ায়—

আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা তার ব্যবহার্য জিনিসের সংস্পর্শ থেকে। যেমন: চিরুনি, তোয়ালে ও বিছানার চাদর।

দাদ আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে।
যেমন: কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল ও ঘোড়া

দাদ রোগের জীবাণু আছে এমন পরিবেশ, বিশেষ করে স্যাঁতস্যাঁতে স্থান থেকে।

দাদ রোগের চিকিৎসাঃ

দাদ রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসা নির্ভর করে শরীরের কোন স্থানে ইনফেকশন হয়েছে এবং ইনফেকশন কতটা গুরুতর তার ওপর।
ঔষধ ব্যবহারের পাশাপাশি নিজের শরীরের অন্য কোনো স্থানে কিংবা বাড়ির সদস্যদের মধ্যে দাদ রোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কিছু নিয়ম মেনে চলাও গুরুত্বপূর্ণ।

দাদের ঔষধঃ

দাদ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধগুলো বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। যেমন: ক্রিম, জেল, লোশন, স্প্রে, পাউডার, ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল।
শরীরের ত্বকে দাদ রোগ হলে সাধারণতঃ মুখে খাওয়ার ঔষধ না দিয়ে ক্রিম, জেল, লোশন, স্প্রে কিংবা পাউডার হিসেবে সরাসরি ত্বকে লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এমন ঔষধের মধ্যে রয়েছে ক্লট্রিমা- জোল, মাইকোনাজোল, টার্বিনাফিন ও কিটোকোনাজল। এগুলো সাধারণতঃ
২–৪ সপ্তাহ একটানা ব্যবহার করতে হয়।

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় ধরে ঔষধ ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে র‍্যাশ সেরে গিয়েছে মনে হলেও ঔষধ ব্যবহার করা বন্ধ করা ঠিক নয়।
সঠিক সময় পর্যন্ত চিকিৎসা না নিলে র‍্যাশ পুরোপুরি না-ও সারতে পারে কিংবা ত্বকে পুনরায় দাদ হতে পারে।

বিশেষ সতর্কতাঃ

দাদ সারাতে স্টেরয়েড ব্যবহার করবেন না।
দাদ রোগের র‍্যাশ দেখা দিলে অনেকে স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম বা মলম ব্যবহার করে থাকেন। ইহা একে বারেই ঠিক নয়। কারণ এ সব ঔষধ চুলকানি ও ত্বকের লালচে ভাব কমাতে সাহায্য করলেও দাদ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে মারতে পারে না। শুধু তাই নয়, এসব ক্রিম ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও দুর্বল করে ফেলে। ফলে দাদ শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি ইনফেকশন ত্বকের গভীরে ঢুকে গুরুতর নানান জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এ ছাড়া স্টেরয়েড মলম দাদের ধরনও পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। এর ফলে ডাক্তারের জন্য সঠিকভাবে দাদ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দাদের চিকিৎসায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ধরনের ক্রিম ব্যবহার করা যাবে না।

দাদ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসাঃ
যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করুন।

ত্বক সবসময় শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন। আক্রান্ত ত্বক স্পর্শ করলে সাথে সাথে হাত ধুয়ে ফেলুন।

দৈনন্দিন ব্যবহারের কাপড় (যেমন: তোয়ালে ও বিছানার চাদর) নিয়মিত ফুটন্ত পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।

যা করবেন নাঃ
দাদ হয়েছে এমন কারও ব্যবহার্য জিনিস (যেমন: তোয়ালে, চিরুনি ও বিছানার চাদর) ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

আক্রান্ত ত্বক স্পর্শ করা অথবা চুলকানো থেকে বিরত থাকুন। না হলে দাদ শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে যেতে পারে। এমনকি চুলকানোর কারণে ত্বকে ভিন্ন আরেকটি জীবাণু আক্রমণ করে ইনফেকশন ঘটাতে পারে, যা দাদের চিকিৎসাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

দাদ রোগ প্রতিরোধে করণীয়ঃ
দাদ রোগে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে দাদ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই দাদ রোগের ঝুঁকি কমাতে সে সব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয় ।

আপনার শিশুর দাদ রোগ হলে তার ক্ষেত্রেও যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। দাদ হলেও শিশুকে স্কুল, ডে-কেয়ার কিংবা নার্সারিতে পাঠাতে পারবেন। তবে শিক্ষক অথবা পরিচর্যাকারীকে তথ্যটি জানিয়ে রাখুন। এতে অন্য শিশুদের সাথে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে সুবিধা হবে এবং দাদ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা যাবে।

নিচের তালিকায় দাদ রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে—
১. অপরিষ্কার শরীরে থাকে জীবাণু। আর অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশে দাদ রোগের জীবাণু থাকার সম্ভাবনা বেশি। এজন্য—

ত্বক সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখুন ;

হাতের এবং পায়ের নখ ছোটো ও পরিষ্কার রাখুন ;

দিনে অন্তত একবার মোজা ও অন্তর্বাস পরিবর্তন করুন।

২. খুব আঁটসাঁট জুতা পরলে এবং অতিরিক্ত ঘাম হলে দাদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এমন জুতো ব্যবহার করুন যা আপনার পায়ের চারপাশে অবাধে বাতাস চলাচল করতে দেয়।

৩. অন্য মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে আসতে হয় এমন খেলাধুলা(যেমন: কুস্তি, হা-ডু-ডু ও বক্সিং) করলেও দাদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এমন খেলাধুলা করলে আপনার ম্যাচ কিংবা অনুশীলনের পর পরই গোসল করুন। ইউনিফর্ম ও সব ধরনের ক্রীড়া সরঞ্জাম (যেমন: হেলমেট) সব সময় পরিষ্কার রাখুন। অন্যদের সাথে ক্রীড়া সরঞ্জাম ভাগাভাগি না করে নিজস্ব সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

৪. স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশে দাদ রোগের ঝুঁকি বেশি । তাই জিম কিংবা চেঞ্জিং রুম ও পাবলিক গোসল খানা এর মতো স্থানে খালি পায়ে হাঁটা থেকে বিরত থাকা উচিত।

৫. পশু পাখির সরাসরি সংস্পর্শে আসলে দাদ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে । তাই প্রাণীর সংস্পর্শে, বিশেষ করে পোষা প্রাণীর সাথে মেলা মেশার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন।

প্রাণীর সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসার পরে সাবান ও ট্যাপের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।

আপনার পোষা প্রাণীর যদি দাদ হয়েছে বলে মনে হয়—যেমন, প্রাণীর শরীরে যদি দাদ দেখতে পান অথবা শরীর থেকে ছোপ ছোপ করে পশম পড়ে যায়—তাহলে তাকে পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

৬. দাদ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও পশুর সংস্পর্শের বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিস ব্যবহার করলেও দাদ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তাই দাদ আছে এমন কারও সাথে পোশাক, তোয়ালে, চাদর বা অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিস শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।

দাদ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অথবা প্রাণীর সংস্পর্শে এসে থাকলে, ত্বকে কোনো পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখুন।

বিশেষ তথ্যঃ
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে দাদ রোগ সহ বিভিন্ন ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক খানি বেড়ে যায়।
যেমন, ডায়াবেটিস রোগী ও দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড নিচ্ছেন কিংবা কেমথেরাপি নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি। তাই এ সব ক্ষেত্রে দাদ রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো মেনে চলা বিশেষভাবে জরুরি।

দাদ রোগের জটিলতাঃ

সঠিক চিকিৎসা না করালে দাদ সেরে না উঠে বরং শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে এমনটা হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

অনেক ক্ষেত্রে দাদ সেরে যাওয়ার পরেও ত্বকে দাগ থেকে যায়।

আক্রান্ত স্থানটি চুলকানোর ফলে ত্বকে ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। এই ফাটল দিয়ে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে নতুন ইনফেকশন তৈরি করে দাদকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। তখন ত্বকের আক্রান্ত স্থানটি লাল ও গরম হয়ে যায়, ফুলে ওঠে, ব্যথা হয় এবং পুঁজ বের হয়।

নখে দাদ হলে নখের স্বাভাবিক আকারের পরিবর্তন ঘটতে পারে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *