ব্যায়াম সুন্নত
নবিজী(সা.) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাজ করতে পছন্দ করতেন। নিজের কাজ নিজেই করতেন।
পরিশ্রম করতেন, ব্যবসা করতেন । বাস্তব জীবনে নবীজীর সব কাজই ছিল সুস্বাস্থ্য, সুস্থতা ও আত্ম নির্ভরশীল হওয়ার অনন্য।
রেসালাতের দায়িত্ব পালনের পাশা পাশি ইসলামের শুরুতেই নিজের কাজ নিজে করতেন।
পরিশ্রম করতেন, সুস্থতা কিংবা অসুস্থতায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। তিনি কোনো কাজকেই ছোট করে দেখেন নি।
এ সম্পর্কে একাধিক হাদিসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাস্তব
জীবনের অনেক ঘটনা সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন।
অনুসরণ যোগ্য নবিজীর সেই কাজ সমূহ কী?
সব সময় ধৈর্য, সহন শীল, পরিশ্রম, কষ্ট ও বীরত্ব পূর্ণ জীবন যাপন করা নবীজীর সুন্নাত।
সব ধরনের বিপদ সহ্য করার এবং কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থার মোকাবিলা করার অভ্যাসও নবীজীর সুন্নাত।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সাদা সিধা ভাবে বীরত্বের জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন।
আবার আরাম প্রিয়, পরিশ্রম বিমুখ, কোমলতা প্রিয়, অলস, সুখ প্রত্যাশী,
আনমনা ও দুনিয়া পূজারি হতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা প্রমাণিত-
১. আরাম প্রিয় না হওয়াঃ
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামেনের গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠান।
তখন তাঁকে উপদেশ দেন যে, ‘হে মুয়াজ! আরাম প্রিয়তা থেকে বিরত থাকবে! কেননা আল্লাহর বান্দাহগণ আরাম প্রিয় হন না। (মিশকাত)
২. সাধারণ জীবন যাপন করাঃ
হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সাদা সিধে জীবন-যাপন করা ঈমানের নির্দেশ।’ (আবু দাউদ)
৩. ব্যায়াম/পরিশ্রম করাঃ
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় সদা সিধে ও বীরত্বের জীবন যাপন করতেন।
সব সময় নিজের বীরত্বপূর্ণ শক্তিকে রক্ষা করা ও বর্ধিত করার চেষ্টা করতেন।
তিনি সাঁতার কাটতেও পছন্দ করতেন। কেননা, সাঁতার কাটায় শরীরের উত্তম ব্যয়াম হয়।
একবার এক পুকুরে তিনি ও তাঁর কিছু সাহাবি সাঁতার কাটতে ছিলেন।
তিনি সাঁতারুদের প্রত্যেকের জুড়ি ঠিক করে দিলেন যে, প্রত্যেককে সাঁতার কেটে তাঁর জুড়ির কাছে পৌঁছবে।
সুতরাং তাঁর জুড়ি নির্বাচিত হলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
তিনি সাঁতার কেটে জুড়ি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত পৌঁছে তার ঘাড় ধরে ফেললেন।
৪. পরিচর্যা ও যত্নবান হওয়াঃ
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওয়ারির জন্য বাহন হিসেবে ঘোড়াকে সব চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।
নিজেই নিজের ঘোড়ার পরিচর্যা করতেন।
নিজের জামার আস্তিন দ্বারা ঘোড়ার মুখ মুছে পরিষ্কার করে দিতেন।
ঘোড়ার গ্রীবা দেশের কেশর সমূহকে নিজের পবিত্র আঙুল দ্বারা ঠিক করে দিতেন এবং বলতেন,
কেয়ামত পর্যন্ত এর কপালের সাথে সৌভাগ্য জড়িত।
৫. শিক্ষাকে মূল্যায়ন করাঃ
হজরত ওকবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘তীর চালান শিখো, ঘোড়ায় আরোহন করো।’
তীর নিক্ষেপ কারীগণ আমার কাছে ঘোড়ায় আরোহন কারীদের থেকে অধিক প্রিয়।
যে ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ করা শেখার পর ছেড়ে দিলো, সে আল্লাহর নেয়ামতের
অ মর্যাদা করলো।’ (আবু দাউদ)
৬. দায়িত্ব পালন করাঃ
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
’যে ব্যক্তি বিপদের সময় মুজাহিদকে পাহারা দিল তাঁর এ রাত ‘লাইলাতুল কদর’-এর রাত অপেক্ষা অনেক উত্তম।’
(মুসতাদরাকে হাকেম)
৭. দুনিয়ার ভালোবাসা ও মৃত্যুর ভয় ত্যাগ করাঃ
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমার উম্মতের ওপর ওই সময় অত্যাসন্ন ;
যখন অন্যান্য জাতির লোকেরা তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেমন খাবারের ওপর লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তখন কোনো এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল(সঃ) ! তখন
কি আমাদের সংখ্যা এতই কম হবে যে,
আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য অন্যান্য জাতির লোকেরা একত্রিত হয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?
আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘না’, সে সময় তোমাদের সংখ্যা কম হবে না বরং সে সময় তোমাদের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
কিন্তু তোমরা বন্যায় ভাসমান খড় কুটার মতো হালকা হবে।
তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব দূরিভূত হয়ে যাবে এবং হীনমন্যতা ও কাপুরুষতা তোমাদের ঘিরে ধরবে।
এরপর এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন,
হে আল্লাহর রাসুল(সঃ) ! এ হীনমন্যতা কেন আসবে?
তিনি বললেন, এ কারণেই যে, ঐ সময় তোমাদের দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যাবে এবং মৃত্যুকে ভয় করতে থাকবে।’
৮. যে কোনো কাজে নির্ভীক হওয়াঃ
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘উত্তম জীবন ঐ ব্যক্তির; যে নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে দ্রুত বেগে দৌড়ায়ে চলে ।
কোথাও বিপদের কথা শুনলে ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে দৌঁড়িয়ে যায়।
হত্যা ও মৃত্যু থেকে এমন নির্ভীক হয়- যেন সে মৃত্যুর খোঁজেই আছে।’
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করে ;
ব্যক্তি পরিবার ও সমাজ জীবনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বাস্তবায়ন করা।
সব সময় নিজেদের ধৈর্য, সহনশীল, পরিশ্রমী, কষ্ট ও বীরত্বপূর্ণ কাজে নবিজীর সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণ করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নাতি জীবন-যাপন করার তাওফিক দান করুন।
হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সুস্থ থাকতে যেসব উপদেশ দেয় ইসলামঃ
রোগ-ব্যাধি মুক্ত জীবন মহান আল্লাহর
এক মহা নেয়ামত ।
হাদিসে পাকে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ থাকার জন্য ইসলামের আলোকে জীবন যাপন করা জরুরী ।
একটি সুন্দর এবং সুস্থ জীবন গড়ে তুলতে ইসলামের ১১টি উপদেশ তুলে ধরা হলো-
১. রোগ-ব্যাধির অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্য-পানীয় ।
এ জন্য অতি ভোজন ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য থেকে বিরত থাকা । হাদিসে এসেছে, ‘সব রোগের কেন্দ্র স্থল পেট।’
২. খাবার গ্রহণে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাঃ
হাদিসে এসেছে, ‘পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানীয় এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ (ইবনে মাজাহ)
৩. খাদ্য দ্রব্য সব ঢেকে রাখা ও যা কিছু পান করা হয় তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন বিশ্বনবি(সঃ) ।
কারণ এতে রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে।
হাদিসে এসেছে, ‘সাবধান! তোমরা (পানি পান করার সময়) পানিতে ফুঁ দেবে না।’ (তিরমিজি)
৪. খাওয়ার আগে ও পরে উভয় হাত ভালো ভাবে ধোয়ার মাধ্যমে হাতকে জীবাণু মুক্ত করার জোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম ।
এটি বিশ্বনবীর সুন্নাত। কারণ হাতে বিষাক্ত জীবাণু থাকার কারণে রোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৫. শরীরকে সুস্থ, সবল ও সতেজ রাখতে খেলাধুলা, ব্যায়াম ও সাঁতারের প্রতি উৎসাহিত করা ।
নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও বিশ্রাম সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
নিয়মিত নামাজ যেমন সুস্থ শরীরের জন্য উপকারি তেমনি রোজা ও হজ মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক।
৬. রোগমুক্ত থাকতে অলসতা ত্যাগ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَأضَلَعَ الدَّيْنِ وَ غَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল আঝযি ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দালাইদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি চিন্তা-ভাবনা,
অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা এবং কাপুরুষতা থেকে।
অধিক ঋণ থেকে এবং দুষ্টু লোকের প্রাধান্য থেকে।’ (বুখারি, নাসাঈ)
৭. মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতার পরিবর্তে মানসিক ও দৈহিক সুস্থতা রোগমুক্ত থাকার পূর্বশর্ত ।
কারণ মানসিক প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
তাই ইসলাম মনসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে বৈবাহিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছে।
৮. ইবাদাত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা ও জিকির-আজকারের দ্বারাও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।
যাতে মানুষ রোগমুক্ত জীবন লাভ করতে পারে।
আল্লাহ বলেন-
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
‘যারা ঈমানদার এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা প্রশান্তি পায়;
জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ প্রশান্তি পায়।’ (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও রোগমুক্ত থাকার অন্যতম উপায় । হাদিসে এসেছে, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ ।
এ কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি করোনায় ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে উভয় হাত ধোয়ার কথা বলেছেন।
হাত না ধুয়ে খাওয়া ও নাক-মুখ ও চোখে হাত দিতে নিষেধ করেছেন। এটি সুন্নাতের দিক নির্দেশনাও বটে।
১০. পরিবেশ দূষণ রোধ করা । পরিবেশ দুষনের মাধ্যমে রোগ-ব্যধি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা বাড়ির আঙ্গিনা
সব দিক থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে।
ইয়াহুদিদের অনুকরণ করবে না । তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে। (তিরমিজি)
১১. স্যানেটারি ব্যবস্থার উন্নয়ন করাঃ
কারণ মল-মূত্র ত্যাগের কারণে রোগ-ব্যাধি অসম্ভব ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তাই পরিবেশ দূষণ কারীদের অভিশপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন ।
হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাক,
যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে।’ (আবু দাউদ)।
সর্বোপরি সকল প্রকার মাদক-দ্রব্য বর্জন এবং নেশাগ্রস্ত জীবন পরিহার করাই হচ্ছে সুস্থতা লাভের অন্যতম উপায় ।
এ কারণে আল্লাহ তাআলা নেশা ও মাদককে হারাম করেছেন।
আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত কাজগুলো নিয়ম মোতাবেক সঠিক ভাবে সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন।
সুস্থ দেহ ও সুন্দর মন লাভ করে রোগমুক্ত জীবন-যাপন করার তাওফিক দান করুন। ” ” আমিন “।