ব্রেইন স্ট্রোক কি
মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের প্রধান অংশ এবং পুরো শরীরের চালিকা শক্তি। মস্তিষ্কের কোষ কলা সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য মস্তিষ্কে রক্তের মাধ্যমে অবিরাম অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ সরবরাহ জরুরি। কোন কারণে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত প্রবাহ হ্রাস পেলে মস্তিষ্কের কোষ কলার মৃত্যু ঘটে এবং শরীর বৃত্তীয় স্বাভাবিক কার্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের পরিমাণ আকস্মিকভাবে হ্রাস পাওয়াকেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেইন স্ট্রোক বলা হয়।
মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্ত সরবরাহে ব্যঘাত ঘটার ফলে যে অব্যবস্থা দ্রুত জন্ম নেয় তাকে বলা হয় স্ট্রোক (Stroke)। দেহের রক্তের মাত্র ২% মস্তিষ্ক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্ক কোষ সমূহ অত্যন্ত সংবেদন- শীল। অক্সিজেন বা শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে দ্রুত এই কোষ গুলো নষ্ট হয়ে যায়। ওই কোষ গুলো শরীরের যেই অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ওই অংশ গুলো পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়।
স্ট্রোকের ধরনঃ
০১। ইসচেমিক (Ischemic) স্ট্রোক (আঞ্চলিকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়া)।
০২। হেমোরেজিক (Hemorrhagic) স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ)।
ব্রেইন স্ট্রোকের কারন গুলোঃ
হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ গুলো মোটামুটি একই, যেমন —
০১। উচ্চ রক্তচাপ।
০২। বেশি কোলেস্টেরল।
০৩। ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ।
০৪। ধুমপান।
০৫।স্থূলতা।
০৬।মদ্যপান।
০৭।পারিবারিক ইতিহাস।
০৮। সাধারণত স্ট্রোক ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষদের বেশি হয়।
ব্রেইন স্টোকের ৮ টি সর্তকতা লক্ষনঃ
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপ, ধূম পান, স্থুলতা, উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং হৃদ রোগে আক্রান্ত রোগীদের ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি । মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে কোন বাধার সৃষ্টি হলেই মূলত ব্রেইন স্ট্রোক হয়।
তবে এর কিছু সতর্কতা সংকেত রয়েছে, যা নিম্নে দেয়া হল-
০১। মুখ বেকে যাওয়াঃ
রোগীর মুখের এক পাশে যদি অসাড়তা অনুভব করে অথবা রোগীর মুখের এক পাশ যদি বেকে যায়, তাহলে তাকে দ্রুত ডাক্তারের নিকট নিয়ে যেতে হবে। সে সময় আপনি রোগীকে একবার হাসার জন্য অনুরোধ করুন। যদি সে হাসতে না পারে, তাহলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। ব্রেইন স্ট্রোক এর প্রধান লক্ষণ মুখ বেকে যাওয়া এবং হাসতে না পারা।
০২. হাতে দুর্বলতাঃ
একজন স্ট্রোকের রোগী তার এক হাতে অথবা উভয় হাতে অবশতা বা দুর্বলতা অনুভব করে। যা স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে। আপনি স্ট্রোকের রোগীকে হাত উপরে উঠানোর জন্য অনুরোধ করুন। সে তার হাত উপরে উঠাতে পারবেন না। উপর দিকে উঠাতে নিলে তার হাত নিচের দিকে নেমে আসবে।
০৩. কথা বলতে অসুবিধাঃ
একজন স্ট্রোকের রোগী বক্তৃতা প্রদানের সময় ঠিকমত কথা বলতে পারবে না। তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য একই প্রশ্ন বারবার করুন। দেখবেন তারা সঠিকভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। তারা একই প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর প্রদান করবে।
০৪. তাদের ভারসাম্য ঠিক থাকবে নাঃ
একজন স্ট্রোকের রোগী তাদের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন না। তারা চলাচলের সময় সমন্বয়ের অভাব অনুভব করে। তারা বিভিন্ন অসুবিধায় ভুগতে থাকে।
০৫. মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করাঃ
কোন কারন ছাড়াই হটাৎ করেই প্রচণ্ড মাথা ব্যাথার অনুভব হতে পারে। সাধারণতঃ এটি হেমোরেজিক স্ট্রোকের প্রতি ইঙ্গিত করে।
০৬. স্বল্প মেয়াদী মেমরি ক্ষতি।
০৭. কালো-আউট বা চাক্ষুষ বৈকল্য পর্ব।
০৮. চাপল্য/ভারসাম্যহীনতা।
এই ৮টি সমস্যার কোন একটি যদি রোগীর মাঝে দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই তাকে দ্রুত ডাক্তারের নিকটে শরণাপন্ন করুন।
কাদের ঝুঁকি বেশিঃ
০১। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার আশংকা বাড়তে থাকে বিশেষ করে ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি বেশি।
০২। উচ্চ রক্তচাপ।
০৩।ডায়াবেটিস।
০৪।রক্তে উচ্চমাত্রার কোলস্টেরল।
০৫। ঋদযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত।
০৬।ধূমপায়ীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি।
৭। কোকেন জাতীয় মাদক সেবনের ফলে ৫০ বছরের চেয়ে কম বয়সীদেরও কখনও কখনও রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুকি কমানোর উপায়ঃ
স্বাস্থ্য সম্মত জীবন ব্যবস্থা বজায় রাখলে অনেক খানি ঝুকি কমানো যায়ঃ
০১। ব্লাড প্রেসার জানা এবং কন্ট্রোল করা।
০২। ধুমপান না করা।
০৩। কোলেসটেরল এবং চর্বি জাতীয় খাবার না খাওয়া।
০৪। নিয়ম মাফিক খাবার খাওয়া।
০৫। সতর্ক ভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা
নিয়ম করে হাটা বা হালকা দৌড়ানো।
০৬। দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা।
০৭। মাদক না নেয়া , মদ্য পান না করা।
শরীরিক পরিক্ষাঃ
০১। শারীরিক পরিমাপঃ
- ব্লাড প্রেসার মাপা।
- রক্তে কোলস্টেরল মাপা।
- ডায়াবেটিস মাপা।
- আমায়িনো এসিড মাপা।
০২। আল্ট্রাসাউন্ডঃ
ঘাড়ের আর্টারির ছবি নিয়ে দেখা যে কথাও রক্ত নালী সরু কিংবা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা।
০৩। আর্টরীয়গ্রাফি (Arteriography):
রক্ত নালীতে এক ধরনের রং প্রবেশ করিয়ে x-ray করানো, এতে রক্ত চলাচলের একটা ছবি পাওয়া যায়।
০৪। CT scan (Computerized Tomography scan) : করে মস্তিস্কের 3D স্ক্যান করা যায়।
০৫। MRI (Magnetic Resonance Imaging) : চুম্বকক্ষেত্র তৈরী করে দেখার চেষ্টা করা হয় যে মস্তিষ্ককলার কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা
০৬। ইকো কার্ডইওগ্রাফি:
Echocardiography তে আল্ট্রা সাউন্ড ব্যবহার করে হৃদপিন্ডের একটা ছবি তুলে দেখা হয় কোনো জমাট রক্ত, বুদ বুদ কিংবা অন্য কিছু (ইংরেজি: embolus) রক্ত চলা চল বন্ধ করছে কিনা)।
রোগ নির্ণয়ঃ
কোন ব্যক্তি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা ঘরে বসে নির্ণয় করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রেঃ
ক) রোগীর হাসতে অসুবিধা হচ্ছে কি না বা হাসতে গেলে গাল বা চোখ বেঁকে বা কুঁচকে যাচ্ছে কিনা,
খ) রোগী দু’হাত উপরে ওঠাতে এবং সোজা অবস্থায় ধরে রাখতে পারছে কিনা অথবা রোগী সঠিক ভাবে কথা বলতে এবং বুঝতে পারছে কিনা তা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সূচকের ওপর নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে লক্ষণের পার্থক্য দেখা দেয়।
‘ইসকেমিক’ এবং ‘হেমোরেজিক’ উভয় স্ট্রোকের একই ধরনের লক্ষণ হতে পারে। প্রধান লক্ষণ হল কথা বলার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়া।
০১। হাতের আঙুল, পায়ের পাতা, শরীরের এক দিকের হাত বা পা নাড়াতে কষ্ট হওয়া, মুখ মণ্ডল নাড়ানোর ক্ষেত্রে অসুবিধা বা মুখের এক দিকের মাংস পেশিতে অসাড়তা দেখা দেয়া, আগে কখনও অনুভূত হয়নি হাত বা পায়ে এমন ধরনের ভার বোধ হওয়া।খিল ধরে যাওয়া,অসাড়তা দেখা দেয়া।দৃষ্টি শক্তি ঝাঁপসা হয়ে পড়া,ঝিমুনি ভাব, শরীরের ভার সাম্য অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়া, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, বমি হওয়া, মলমূত্র নিয়ন্ত্রণে সমস্যা।মানসিক বিভ্রম বা বিষণ্নতাও দেখা দেওয়া।
মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ জনিত স্ট্রোক একটি ভয়ানক জরুরি অবস্থা (Critical condition) এবং তা যদি মস্তিষ্কের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঘটে, তবে তা দ্রুত রোগীর জীবনাবসানের কারণ হয়।
যেমনঃ
০১। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ (uncontrolled High Blood Pressure),
০২। বহুমূত্র (Diabetes),
০৩। মাথায় তীব্র আঘাত (severe Head injury)
এছাড়াও কতিপয় জন্মগত কারণ থাকে, যেমনঃ
০১। ধমনীর দেয়ালের দুর্বল অংশ ফেটে যাওয়া (Ruptured Aneurysm),
০২। ধমণী-শিরার ভেতর অস্বাভাবিক সংমিশ্রণ, ইত্যাদি থেকে রক্ত ক্ষরণ (bleeding from Arteriovenous malformation) সচরাচর ঘটে থাকে।
রোগ নির্ণয়ে দ্রুত ব্যাবস্থা অতীব জরুরী। কেননা মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণের পর কোষ গুলো ফুলে উঠতে শুরু করে, মস্তিষ্ক করোটি বা স্কাল চারিধার থেকে প্রায় বদ্ধ বিধায় আক্রান্ত মস্তিষ্ক দ্রুত জটিলতার শিকার হয়। মস্তিষ্ক হারনিয়েশন (ইংরেজি: Hernia) হচ্ছে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি-
অর্থাৎ দুর্বল অংশ গলিয়ে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বের হয়ে আসে এবং রোগী দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ধমণী বা শিরা বাহিত জমাট বাধা রক্ত পিন্ড (embolus) মস্তিষ্কে কোন এলাকায় রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটালে জন্ম নেয় অপর প্রকার স্ট্রোক—রক্ত চলাচল শূন্য অকার্যকর মস্তিষ্ক বা সেরিব্রাল ইনফার্কশন (Cerebral Infarction)।
এ ক্ষেত্রেও রোগ নির্ণয়ে দ্রুত প্রয়োজন। জমাট বাধা রক্ত অম্বুরকে দ্রুত ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব এবং এ জন্য শল্য চিকিৎসক মাত্র ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় পান ।
চিকিৎসাঃ
অসুখের ধরন জেনে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ‘ইসকেমিক’ স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ‘অ্যাসপিরিন’ বা অন্য কোন ধরনের রক্ত পাতলা করার ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। কখনও কখনও শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে এ ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করা হয় এমনকি ক্যাথেটারের সাহায্যে তা সরাসরি মস্তিকেও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণ করার জন্য বা সরু হয়ে যাওয়া শিরার প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য মস্তিষ্কে অপারেশন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কখনও কখনও হূৎপিণ্ডের ন্যায় এ ক্ষেত্রেও এনজিওপ্লাস্টি প্রক্রিয়ায় ‘স্ট্যান্টিং’ করার ব্যবস্থাও করা হয়।
‘হেমোজেরিক’ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত পাত বন্ধ ও মস্তিষ্কের চাপ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। ক্ষতি গ্রস্ত শিরা মেরামত করার লক্ষ্যে অপারেশন করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। জটিল ক্ষেত্রে শিরার কিছুটা অংশ কেটে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব রোগী যেন স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
পুনর্বাসনঃ
চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই রোগী যেন অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজস্ব দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে সে লক্ষ্যে বয়স, স্বাস্থ্য এবং ক্ষতির পরিমাণ ভেদে বিভিন্ন মাত্রায় পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ গুলোর মধ্যে ‘ফিজিওথেরাপি’, শরীরচর্চা, ভাষা ব্যবহারে সাহায্য করা বা বিকল্প পদ্ধতিতে মনের ভাব প্রকাশের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া মানসিক সুস্থতা লাভের ব্যাপারেও বিশেষ মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন থাকে।