রক্ত শূন্যতার ৫ টি লক্ষণ
বিভিন্ন কারণে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এটি সবচেয়ে বড় অপুষ্টি আয়রনের অভাব কিংবা থালাসেমিয়ার মতো রোগ-এর কারণ হতে পারে। এ ছাড়াও শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্ষত থেকে হওয়া রক্তক্ষরণের ফলেও শরীরে দেখা দিতে পারে রক্তশূন্যতা। পরিবারের কেউ রক্তশূন্যতায় ভুগলে অন্যান্যদেরও হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার রক্তে ১৩৫ গ্রাম। আর নারীদের ১২০ গ্রামের কম হলেই তাকে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার লক্ষণ বলা হয়।
তবে সব সময় তো রক্ত পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এ কারণে দীর্ঘদিন রক্তশূন্যতায় ভুগলেও অনেকেই টের পান না। অজান্তেই এ সমস্যা থেকে যায় শরীরে।
তবে এক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ আছে রক্তশূন্যতারঃ
০১) রক্তের হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন পরিবহণ করে। ফলে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে রোগী সব কাজে হাঁপিয়ে বা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
০২) রক্তাল্পতার প্রভাবে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যেতে শুরু করে। অনেকেই ভাবেন, ত্বক হয়তো উজ্জ্বল হচ্ছে! এ ছাড়াও রক্ত শূন্যতার কারণে চোখের ভেতরের মাংস পেশিগুলোও লাল রং হারিয়ে ফেলে।
০৩) শরীরের আয়রন কমে গেলেই দেখা দেয় রক্তশূন্যতা। এর প্রভাবে চুলও পড়ে যেতে পারে। কাজেই অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যাও রক্ত স্বল্পতার লক্ষণ হতে পারে।
০৪) রক্তশূন্যতার রোগীরা অল্পেই ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় ভোগেন। যা, ডেকে আনতে পারে মাথাব্যথাও। কিছু ক্ষেত্রে রোগী মানসিক অবসাদের শিকার হতে পারেন।
০৫) হাত-পা ঠান্ডা হয়ে থাকাও কিন্তু রক্তশূন্যতার ইঙ্গিত দেয়। তাই এসব লক্ষণ দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর সময়মতো চিকিৎসা না করালে ঘটতে পারে নানা বিপদ।
প্রতিরোধে করণীয়-
অনেক ধরনের রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করা যায় না। তবে আপনি যদি আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া ও ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়ায় ভোগেন, তাহলে ডায়েট পরিবর্তনের মাধ্যমে তা সারাতে পারবেন। এজন্য আয়রন, ফোলেট, ভিটামিন বি ১২ ও ভিটামিন সি জাতীয়
খাবার বেশি করে খেতে হবে।
যে কোনো বড় অসুখের শুরু হতে পারে এই রক্তশূন্যতা থেকেই। তাই রক্তশূন্যতাকে খুব বড় কোনো রোগ বলে মনে না করা ভুল। পুষ্টিবিদদের মতে, রক্তশূন্যতা বিশ্বের সবেচেয়ে বড় অপুষ্টিজনিত সমস্যা। তাই
এই সমস্যাকে হেলাফেলা করা ঠিক নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর জন্য রক্তে হিমোগ্লোবিন ১২.১ থেকে ১৫.১ গ্রাম/ডেসিলিটার, পুরুষের রক্তে ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ডেসিলিটার, শিশুদের রক্তে ১১ থেকে ১৬ গ্রাম/ডেসিলিটার থাকা স্বাভাবিক। রক্তে হিমোগ্লোবিন -এর চেয়ে কমে গেলে তাকে ‘রক্তশূন্যতা’ বলেই ধরে নেন চিকিৎসকরা।
রক্তশূন্যতা লক্ষণঃ
০১) রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তি অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। সামান্য কাজ করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
০২) অনেক সময় রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বক ফ্যাকাশে হতে শুরু করে।
০৩) আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা হতে পারে। রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তির আয়রনের অভাবে অতিরিক্ত চুল ঝরে যেতে শুরু করে।
০৪) রক্তশূন্যতা আক্রান্তকে বিষণ্ণতায় ভুগতে দেখা যায়। সারাক্ষণ দুর্বলতা আর মাথাব্যথা হওয়ার কারণে রোগীকে ক্রমশ বিষণ্ণতা গ্রাস করে।
০৫) রক্তশূন্যতা আরো একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হল, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া। রক্তশূন্যতার কারণে হৃৎপিণ্ড পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত শরীরে সঞ্চালনের জন্য পাম্প করতে পারে না। ফলে হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে যায়।
রক্তশূন্যতার কারণঃ
পুষ্টিহীনতা আর শরীরে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে।
০১) দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ সেবনের ফলে রক্তশূন্যতার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
০২) থ্যালাসেমিয়াসহ কিছু জন্মগত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রক্তশূন্যতায় ভোগেন।
০৩) পাকস্থলী ও অন্ত্রের ক্ষত বা আলসারের কারণে ক্রমাগত বমি বা পায়খানার সঙ্গে রক্তক্ষরণ হওয়া, অন্ত্রে কৃমির সংক্রমণ বা অর্শরোগে (পাইলস) রোগীর অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণেও রক্তশূন্যতার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
০৪) খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ লৌহের যোগান না পেলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। সাধারণতঃ প্রাণীজ খাবারের তুলনায় উদ্ভিজ্জ খাবারে লৌহের যোগান কম থাকে, তাই প্রাণীর কলিজা এবং লাল মাংস ইত্যাদি লৌহ সমৃদ্ধ খাবার না খেলে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
০৫) দীর্ঘমেয়াদী কোনো রোগী, প্রোটিন বা আমিষ জাতিও খাবার কম খেলে, হজমে সমস্যা, পাকস্থলীর বাইপাস অপারেশন ইত্যাদি কারনে পাকস্থলির খাবার থেকে লৌহ শোষণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং এর ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
০৬) অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা কম তৈরি হলে এই সমস্যা হতে পারে। এর কারণগুলো হল- অস্থিমজ্জার স্বল্পতা, লৌহ, ভিটামিন বি১২ অথবা ফলিক এসিডের অভাব (মাসিক, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, দীর্ঘদিন রক্তক্ষরণ জনিত কারনে) দীর্ঘস্থায়ী।
০৭) জীবাণু সংক্রমণ, রঞ্জন রশ্মি বা তেজষ্ক্রিয় রশ্মির প্রভাব, থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ বা লিভারের অসুখ, বিভিন্ন প্রকার ওষুধ সেবন, কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার ইত্যাদি।
অতিরিক্ত পরিমাণে লোহিত কণিকা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে অথবা জন্মগতভাবে লোহিত কণিকাতে ত্রুটি থাকলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। আঘাতজনিত কারণে সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষরণ, পাইলস, পেপটিক আলসার, বক্র কৃমির সংক্রমণ, মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের সময় অধিক রক্তক্ষরণ, ঘন ঘন গর্ভধারণ ও প্রসব ইত্যাদি।
করণীয়ঃ
অ্যানিমিয়ার জন্য মূলত অপর্যাপ্ত লোহিত কণিকাকে দায়ী করা হয়। এই পরিস্থিতি মূলত শরীরে আয়রনের অভাবে হয়ে থাকে। তাই যারা রক্তশূন্যতায় ভোগেন দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। তবে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেও রক্তশূন্যতা দূর করতে পারেন।
এই খাবারগুলো হলো-
০১) ভিটামিন সি খাদ্য থেকে সহজে আয়রন শোষণ করে দেহে যোগান দেয়। টমেটো, লেবু, টক জাতীয় ফল, ক্যাপসিকাম ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস। নিয়মিত এসব খাদ্য উপাদান খেলে রক্তে আয়রনের পরিমান বজায় থাকে।
০২) খাদ্যতালিকায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। যেমন মাংস, মাছ, বাদাম, সবুজ শাকসবজি, কচু,কলিজা এসব খাবার প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
০৩) প্রতিদিন এক চা চামচ মধু আর এক চা চামচ ভিনেগার খাওয়ার অভ্যাস করুন। মধুতে যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন, মেঙ্গানিজ ও কপার পাবেন, যা আপনার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক রাখবে।
০৪) প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন বি১২ আর ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার রাখুন। কমলা, কলা, মটরশুঁটি, দুদ্ধজাত খাদ্য, ডিম এইগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন বি১২ আর ফোলেট আছে।
০৫) অ্যানিমিয়ার রোগীর জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিতে সবচেয়ে উপকারী চিকিৎসা হল হাত, পা ম্যাসেজ করা। এতে করে শরীরে রক্ত চলাচল সঠিক উপায়ে হবে।
০৬) এক কাপ আপেলের জুসের সঙ্গে এক কাপ বিট রুটের জুস আর চিনি মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খান।
০৭) একটি পাকা কলার সঙ্গে এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন খেতে পারেন। এভাবে প্রতিদিন ২টি করে কলা আর মধুর সংমিশ্রণ খেলে রক্তশূন্যতা দূর হবে।
০৮) কফি, চা রেড ওয়াইন আয়রন শোষণে বাধা দেয়। তাই যাদের রক্তশূন্যতা আছে তাদের এসব পানীয় পরিহার করা হবে স্বাস্থ্যসম্মত।
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতাঃ
শিশুর শরীরে আরবিসি বা লোহিতকণিকার সংখ্যা কমে যায়। এই লোহিতকণিকা ব্রেনে এবং শিশুর সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করে। অস্থিমজ্জায় নতুন নতুন লোহিতকণিকা উৎপন্ন হয় এবং তা রক্তপ্রবাহ স্রোতে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তাদের আয়ুষ্কাল হবে ১২০ দিনের।
শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে প্রধানত তিন কারণে-
প্রয়োজন মাফিক আরবিসি উৎপন্ন না হয়ে থাকলে
- নবজাতক শিশু উচ্চমাত্রার হিমোগ্লোবিন ও লোহিতকণিকা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। তবে দুই মাস বয়সে এসে তা নিচু মাত্রায় চলে আসে। এরপর সিগন্যাল পেয়ে বেশি আরবিসি উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলে। এই সময়ের নির্দোষ অ্যানিমিয়া ক্ষতিকর নয়। কোনো ওষুধের চিকিৎসা লাগে না, শুধু মায়ের দুধপানই যথেষ্ট।
- দেহে যখন সুস্থ আরবিসি তৈরি হয় না, তখনও এ সংকট সৃষ্টি হয়; যেমন- আয়রন বা অন্যান্য উপাদানের ঘাটতিজনিত কারণে। দুই বছরের কম বয়সী শিশু এবং বয়ঃসন্ধিকালে শিশু অ্যানিমিয়ার প্রধানতঃ আয়রন ঘাটতিজনিত কারণে হয়ে থাকে। বিশেষ করে কন্যাশিশুর যখন মাসিক শুরু হয়।
- ফলিক এসিড ও বি-১২ ভিটামিনের অভাবে অ্যানিমিয়া হয়। শিশু বয়সের আন্ত্রিক অসুখ সিলিয়াক ডিজিজে ভোগা রোগী এ অবস্থায় পতিত হয়।
- অস্থিমজ্জা যখন রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না, রক্তাল্পতার লক্ষণ নিয়ে সূচিত হয়। এ এক ভয়াবহ অসুখ। এর নাম অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়া। ক্রাইসিস নিয়েও প্রকাশ পেতে পারে। ফ্যানকোনি ও টিইসি- এগুলোও এর অন্য রূপ।
- দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা শিশু রক্তস্বল্পতায় পড়ে। ক্রোনিক কিডনি, হাইপোথাইরয়ডিজম, এডিসনস ডিজিজ, পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা, যেখানে আরবিসি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন মেলে না, এই অসুবিধা নিয়ে আসে। সিসা পয়জনিংয়ের শিকার হলে শিশু রক্তশূন্যতায় ভোগে। হিমোগ্লোবিনের আয়রন অংশজাত হিম তৈরিতে বিষাক্ত সিসা বাধা দেয়।
লোহিতকণিকা যদি ভেঙ্গে যায় অন্য নাম হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া। নানাবিধ কারণে উৎপন্ন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে লোহিতকণিকা নষ্ট হয়ে যায়, যেমন – - ইনফেকশন, ড্রাগস, সর্প দংশন, বার্ন।
- ক্রোনিক লিভার ডিজিজ। মা বা বাচ্চার ব্লাড গ্রুপে গড়মিল আর এইচ রক্ত গ্রুপের প্রতিক্রিয়াজনিত।
- সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, জি সিক্স পিডির অভাব।
- উচ্চ রক্তচাপ, প্লীহা স্ফীতি।
রক্তপাতজনিত কারণেঃ - ইনজুরি, বেশি রক্তস্রাব, পাকস্থলী-আন্ত্রিক রক্তপাত।
- কৃমির সংক্রমণ, বিশেষ করে বক্র কৃমি।
- রক্তপাতজনিত অসুখ-হিমোফাইলিয়া।
রোগচিহ্নঃ - ফ্যাকাশে ভাব ত্বকে, ঠোঁটে, হাতে-পায়ের তালুতে।
- খিটখিটে মেজাজ, অতিশয় ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা।
কারণ অনুযায়ী অন্যান্য লক্ষণঃ
আয়রন ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়ায় শিশুর অমনোযোগিতা ও দৈহিক বাড়ন ঠিকমতো না হওয়া লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে।
জন্ডিস কালো চা রঙের মূত্র, একটুতেই রক্তপাত সমস্যা প্রভৃতি।
পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ - সিবিসি, ব্লাড স্মিয়ার। ব্লাড আয়রন লেভেল।
- হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস-থ্যালাসেমিয়াতে।
- বোনম্যারো-অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়া, লিউকেমিয়ায়।