লিভার সিরোসিস
লিভার সিরোসিস রোগ সম্পর্কে অনেকেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। এটা যকৃতের জটিল একটি রোগ। এ রোগ একবার হয়ে গেলে নিরাময় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে-এর অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যকৃতের কাজ কীঃ
মানুষের পেটের ওপরের অংশের ডান দিকে যকৃতের অবস্থান, যা মানবদেহে বিপাক ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে।
খাদ্যের অতিরিক্ত গ্লুকোজ যকৃতে গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চিত থাকে, যা পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে শক্তির জোগান দিতে পারে। যকৃৎ শরীরের অতি প্রয়োজনীয় অ্যালবুমিন এবং অন্যান্য প্রোটিনের মূল জোগানদাতা। যকৃতে তৈরি হয় রক্ত তরল রাখার বেশ কিছু উপাদান । আমাদের শরীরের অনেক দূষিত উপাদান, বর্জ্য, ওষুধের বিপাকজনিত বর্জ্য বের করে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লিভার। কাজেই লিভার সিরোসিস হলে লিভারের সব কাজ ব্যাহত হয়।
নানা ধরনের উপসর্গ নিয়ে লিভার সিরোসিস উপস্থিতি জানান দিতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হলোঃ ক্লান্তি দুর্বলতা,অরুচি
ও ওজন হ্রাস । লিভার সিরোসিসে জন্ডিস হতে পারে। কখনো জন্ডিস এত মৃদু হয় যে ,
পরীক্ষা–নিরীক্ষায় হঠাৎ লিভার ফাংশন টেস্ট করলে ধরা পড়ে।
কেন হয় লিভার সিরোসিসঃ
স্বাভাবিক অবস্থায় লিভারের কোষকলা নরম ও মসৃণ। সিরোসিস হলে লিভারের কলাগুলো শক্ত ও দানাদার হয়ে যায়। লিভারের গঠনগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে এবং একসময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।
নানা কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে। উন্নত বিশ্বে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান। আবার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং হেপাটাইটিস ডি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণে সাধারণতঃ মানুষের লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে। বাংলাদেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস।
এ ছাড়া পৃথিবীজুড়ে ফ্যাটি লিভার থেকে সৃষ্ট ন্যাশ (নন অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস) লিভার সিরোসিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ । আমাদের দেশেও প্রচুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে ফ্যাটি লিভারের । এর বাইরে লিভার সিরোসিসের কিছু বিরল কারণের মধ্যে আছে উইলসন ডিজিজ, হেমোক্রোমাটোসিস এবং আলফা-ওয়ান অ্যান্ট্রিপসিন ডেফিসিয়েন্সি।
হেপাটাইটিস বি ও সি রক্তবাহিত রোগ । সাধারণতঃ অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে থাকে। তাই রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে রক্তদাতার রক্তে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস আছে কি না, সেটা অবশ্যই দেখে নিতে হবে । রক্ত নেওয়া যাবে না পেশাদার রক্তদাতার কাছ থেকে । এ দুটি ভাইরাস ছড়াতে পারে একই সুচ-সিরিঞ্জ ব্যবহার করলেও । এসব ভাইরাস ছড়াতে পারে সেলুনের কাঁচি, রেজর ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলেও । অনিরাপদ যৌন মিলনও হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণের কারণ।
অ্যালকোহল জনিত সিরোসিস আমাদের দেশে আগে খুব একটা বেশি ছিল না। তবে আজকাল ধীরে ধীরে এর হারও বাড়ছে। ফ্যাটি লিভার ডিজিজের হারও দ্রুত বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ শর্করা বিশেষ করে ট্রাইগ্লিসারাইড, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং অতিরিক্ত শারীরিক ওজন ফ্যাটি লিভারের অন্যতম কারণ।
পরিস্থিতি জটিল হলে পেটে পানি জমে ফুলে যায়, পায়েও পানি আসতে পারে। সিরোসিসের রোগীর রক্তে বিপাকজনিত বর্জ্য জমে যায় বলে মস্তিষ্কে এনকেফালোপ্যাথি হয়, ফলাফল স্বরূপ রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অনেকেরই রক্তবমি এবং পায়খানার সঙ্গে কালো রক্ত যেতে পারে ।
লিভার সিরোসিস থেকে ক্রমে লিভারে ক্যানসার হওয়া অস্বাভাবিক নয় । সে ক্ষেত্রে পেটে শক্ত চাকা আর পানি জমে।
চিকিৎসা কীঃ
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা বেশ জটিল। চিকিৎসা হতাশাব্যাঞ্জকও । কারণ , এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেবল উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা (যেমন পেটের পানি অপসারণ, রক্তবমি রোধ ইত্যাদি) করা হয়। কারণ-এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন, যা কিনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তা ছাড়া আমাদের দেশে লিভারদাতা পাওয়াও খুবই কঠিন।
পেটে বেশি পানি জমলে সুইয়ের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে বের করে দিতে হয়। এন্ডোস্কপি করে খাদ্যনালিতে ভ্যারিসেস (ফোলা রক্তনালি, যা থেকে রক্তপাতের ঝুঁকি আছে) থাকলে বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে সেগুলো থেকে রক্তপাত বন্ধ করা হয়। সিরোসিসের রোগীদের বিশেষ ধরনের খাদ্যব্যবস্থা দরকার হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এনকেফালোপ্যাথি হয় বলে সব সময় মল নরম রাখার চেষ্টা করতে হয় । পেটের অভ্যন্তরের রক্তনালির রক্তচাপ বেশি থাকে। একে বলে পোর্টাল হাইপারটেনশন। এই রক্তচাপ কমাতে ওষুধ দিতে হয় । তবে বেশির ভাগ ওষুধ যেমন ঘুমের ওষুধ , ব্যথানাশক ইত্যাদি সিরোসিসের রোগীর জন্য ক্ষতিকর ।
প্রতিরোধই উত্তমঃ
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে বর্তমানে কার্যকর টিকা আছে । তা ছোট-বড় সবাইকেই নিতে হবে। দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমে শিশুদের বিনা মূল্যে টিকাটি দেওয়া হয়। বড়দের মধ্যে যাঁরা নেননি, তাঁরা টিকা কিনে দিয়ে দিতে পারেন।
নিরাপদ রক্তসঞ্চালন নিশ্চিত করা খুবই জরুরি । কোনো প্রয়োজনে রক্ত নিতে হলে অবশ্যই নিরাপদ রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। রক্ত কেনাবেচা সম্পূর্ণ বেআইনি ও বিপদজ্জনক।
ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ, রেজার ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। মাদকাসক্ত যাঁরা শিরায় মাদক গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি । কারণ, তাঁরা প্রায়ই একই সিরিঞ্জ কয়েকজনে ব্যবহার করে থাকেন । তাই মাদক ও অ্যালকোহল বর্জন করুন।
অনিরাপদ যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলতে হবে।
কেউ হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে সংক্রমিত হলে দেরি না করে পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে হবে। বর্তমানে এসব সংক্রমণের কার্যকর চিকিৎসা আছে। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ থেকেই সিরোসিস হয়ে থাকে।
ওজন ও রক্তের শর্করা ও চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যেন ফ্যাটি লিভার না হয় । সব ফ্যাটি লিভারই যে সিরোসিসে রূপ নেবে তা নয়, তবে ফ্যাটি লিভার হলে অবশ্যই জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।
লিভার সিরোসিস একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। লিভারের নানারকম রোগের মধ্যে এটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ের একটি রোগ বলে গণ্য করা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে যকৃতের ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন ছাড়া পুরোপুরি আরোগ্য হয় না।
দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটির বেশি মানুষ। এদের পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ রোগী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত । সেই হিসাবে দেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যখন লিভারের রোগের নানা পর্যায়ের পর কোষগুলো এমনভাবে আক্রান্ত হয় যে, লিভার আর কাজ করতে পারে না, সেই পর্যায়কে লিভার সিরোসিস বলে বর্ণনা করা হয়।
যখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, তখন লিভার বা যকৃৎ তার স্বাভাবিক কাজগুলো, যেমন বিপাক ক্রিয়া, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি, ওষুধ ও রাসায়নিকের শোষণ, খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি করতে পারে না।
লিভার সিরোসিস হলে লিভার বা যকৃতে সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিসের বিস্তার ঘটে। যকৃতে তখন ছোট ছোট দানা বাঁধে। আস্তে আস্তে সেটির বিস্তার ঘটতে থাকে।
ফাইব্রোসিস ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আর লিভার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে না, ফলে লিভার সংকুচিত হয়ে পড়ে।
বি, সি এবং ডি ভাইরাসের আক্রমণে লিভারে প্রদাহের তৈরি হয়। লিভারে প্রদাহের তৈরি করে বলেই একে বলা হয় হেপাটাইটিস, যার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
একটি বড় কারণ ফ্যাটি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে লিভারে যদি মাত্রাতিরিক্ত চর্বি জমে, তাহলে লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এক সময় এর ফলেও লিভার সিরোসিস হতে পারে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ফ্যাটি লিভার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী ১৫ বছর পর লিভার সিরোসিসের বড় কারণ হবে ফ্যাটি লিভার । আর এদের অন্তত ২০ শতাংশ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে।”
দেশের বাসিন্দাদের অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত বলে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে । এদের মধ্যে ১৫ শতাংশের নন-অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস জটিলতা রয়েছে।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, স্থূলতা, খাদ্যাভ্যাস, রক্তে কোলোরেস্টল ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে।
অতিরিক্ত মদ্যপান, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ইচ্ছেমত ওষুধ খাওয়া, রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া দূষিত পানীয়, ব্যবহার করা বরফ, খোলা শরবত বা ফলের মাধ্যমে যকৃতের রোগ ছড়াতে পারে।
লিভার সিরোসিস আর লিভারের ক্যান্সার এক রোগ নয়। তবে লিভার সিরোসিস থেকে লিভারের ক্যান্সার হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, লিভার সিরোসিসের শুরুর দিকে তেমন উপসর্গ থাকে না । অনেক সময় পেটের আলট্রাসাউন্ড কিংবা পেটে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এই রোগটি ধরা পড়ে। জন্ডিসও যকৃতের রোগের একটি লক্ষণ। রক্ত পরীক্ষা, বায়োপসি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমেও রোগটি শনাক্ত হতে পারে।
লিভার সিরোসিস হলে পেটে বা পায়ে পানি আসতে পারে, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হতে পারে। অনেকে চেতনা হারিয়ে কোমায়ও চলে যেতে পারেন।
বর্তমানে বিশ্বে লিভার সিরোসিসের অনেক আধুনিক চিকিৎসা উদ্ভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-র ক্ষেত্রে শিশুদের জন্মের পরপরই টিকা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করাও এই টিকা নিতে পারেন।
দুষিত পানি, অতিরিক্ত মদ্যপান, খোলা ফলমূলের মতো যেসব কারণে যকৃতের রোগ হয়, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
অনেকগুলো কারণে লিভার সিরোসিস বা লিভারের রোগ হয়ে থাকে। সতর্ক হলে অনেকাংশে এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, শারীরিক পরিশ্রম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা, কোলোস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা, স্থূলতা দূর করা ইত্যাদির মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।
বাংলাদেশে এখন লিভার বা যকৃতের উন্নত মানের চিকিৎসা হচ্ছে। বড় শহরগুলোতে তো বটেই, জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও চিকিৎসা সহজলভ্য হয়েছে।
লিভার সিরোসিস হলে সারা জীবন বহন করতে হয়, পুরোপুরি আরোগ্য লাভ হয় না। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জটিলতা দূর করা যেতে পারে।”
এই রোগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা যকৃত প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশেই এখন যকৃতের প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে।
তবে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে।