হেনরি ফোর্ড
সফল ব্যক্তিদের ব্যর্থতার গল্প –
ফোর্ড মোটর কোম্পানির নাম কমবেশি সকলেই শুনে থাকবেন।হেনরি ফোর্ড এই অটোমোবাইল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, হেনরি ফোর্ড একজন কৃষকের সন্তানছিলেন ।
স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে
পড়া এই মানুষটিই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শিল্পপতি এবং আধুনিক অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম রূপকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এমনকি জার্মান নাৎসি বাহিনীর প্রধান, হিটলারও হেনরি ফোর্ডের জ্ঞান, প্রজ্ঞার গুণমুগ্ধ ছিলেন।
হিটলার বলেছিলেন,আমার অনুপ্রেরণা হেনরি !
এমন ক্ষমতাধর একজন শিল্পপতি হয়ে ওঠার পথটা হেনরি ফোর্ডের জন্য সহজ ছিলোনা। নিজের একটা অটোমোবাইল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কীভাবে
বাঁধা পেরিয়েএকজন বিজনেস আইকনে পরিণত হলেন, সেই গল্প জানা যাক।
জন্ম এবং জীবন যুদ্ধঃ
হেনরি ফোর্ড জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৩ সালের ৩০ জুলাই। মিশিগানের গ্রিনফিল্ড ডেট্রয়েটের এক কৃষকের পরিবারে তাঁর জন্ম। উইলিয়াম ফোর্ড তাঁর বাবা এবং মা মেরি ফোর্ড।
আট ভাইবোনের পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও তিনি পৈত্রিক কৃষিকাজ বা খামার দেখাশোনার কাজে কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। বরং তাঁর ঝোঁক ছিল পুরনো যন্ত্রপাতির দিকে।
ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জিনিয়া রিংগের প্রতি তাঁর আগ্রহের কারণে ছোটবেলায় বোঝা গিয়েছিল তিনি বড় হয়ে শিল্পপতি হবেন।
ছোটবেলা থেকেই হেনরি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলেও তাঁর এই চঞ্চলতা এবং দুষ্টামির কারণে বেশি দিন স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি।
তাঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হল।
১৮৭৫ সালে তাঁর মা মারা যাওয়ার পর তিনি বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। লেখাপড়া
বন্ধ হয়ে গেলেও যন্ত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ কমে যায়নি।
১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি ছোট খাটো যান্ত্রিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করতেন। তাঁর যন্ত্রের প্রতি আগ্রহ দেখে
তাঁর বাবাও তাঁকে এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতেন।
তাঁর বাবার ঘড়ি তিনি নিজেই নষ্ট করে আবার নিজেই ঠিক করে নিয়ে আসতেন। বাবার ঘড়ি নষ্ট করে আবার মেরামত করা ছিল তাঁর কাছে প্রতিদিনকার খেলার একটা অংশ।
নিজের কারখানায় হেনরি ফোর্ড খেলতে খেলতেই ১৬ বছর বয়সে তিনি ঘর ছাড়েন। তারপর ডেট্রয়েট শহরের মেকানিকের কাজে যোগ দেন।
সেখানে তিনি জেমস ফ্লাওয়ারের সাথে কাজ করতেন। তারপর তিনি কাজ করেন ডেট্রয়েট ড্রাই ডকে।
১৯৮২ সালে তিনি আবার নিজ ঘরে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক কৃষি ফার্মে তিন বছর কাজ করেন। এই সময়ে তিনি নিজের কৃষি খামারে বাস্প বা স্টিম ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করেন।
পরবর্তীতে তাঁকে ওয়েস্টিন হাউজ স্টিম ইঞ্জিন কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এই সময়ে তিনি গোল্ড স্মিথের ব্রায়ান অ্যান্ড স্ট্র্যাটন কলেজে বুককিপিং নিয়ে পড়া- শোনাও করতেন।
অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফোর্ড এর উত্থানঃ
১৮৯১ সালে হেনরি টমাস আলভা এডিসনের এডিসন লাইটিং কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নাইট শিফটে কাজ করতেন এবং দিনের বেলা অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাক্টিস করতেন।
১৯৯৩ সালে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রোমোশন পাওয়ার পর, তিনি বেশ ভাল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন এবং অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও তাঁর জ্ঞানের পরিধি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছিল।
এবং এরপরেই তিনি গ্যসোলিন ইঞ্জিনের গাড়ি বানানোর কাজে আরো ভাল ভাবে মনোনিবেশ করেন।
১৮৯২ সালে প্রথম গাড়ি বানালেও সেই গাড়ির কিছু সমস্যা ছিল। এরপর তিনি ১৮৯৬ সালে তৈরি করেন ফোর্ড কোয়াড্রিসাইকেল।
এই গাড়িটি কয়েকবার রাস্তায় টেস্ট ড্রাইভও করেছিলেন। এবং গাড়িটিকে আরো নিখুঁত করার কাজ করে যাচ্ছিলেন।
এরপর তিনি টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানির সাথে আলোচনায় বসেন এবং এডিসনের অনুপ্রেরণায় ২য় গাড়ি তৈরি করেছিলেন। যার সম্পূর্ণ কাজ ১৮৯৮ সালে শেষ হয়েছিল।
টমাস আল্ভা এডিসনের সাথে
হেনরি ফোর্ডঃ
দ্বিতীয় গাড়ি তৈরি করার পর তিনি আর কারো দ্বারস্থ হন নি। এবার পরিকল্পনা করেন নিজেই একটা অটোমোবাইল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করবেন। যেই কথা সেই কাজ।
১৮৯৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি ডেট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে- ছিলেন। তখনকার দামের তুলনায় এই কোম্পানির গাড়িগুলোর মান তেমন একটা ভাল ছিল না। কিন্তু হেনরি সবসময় চাইতেন মানুষ যেন কম দামে ভাল মানের গাড়ি কেনার সুবিধা পায়। তাই তিনি এটা নিয়ে আরো কাজ করেন।
তিনি নিজের ডিজাইনে ১৯০১ সালে ২৬ হর্স পাওয়ারের একটি গাড়ি তৈরি করেছিলেন । এবং ডেট্রয়েট অটোমোবাইল কোম্পানির স্টক হোল্ডারদের সহায়তায় গড়ে তোলেন ফোর্ড মোটর কোম্পানি।
নিজের নামে গড়া কোম্পানিতে তিনি ছিলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পরে সেখানে কন্সাল্টেন্ট হিসেবে লিলান্ডকে নিয়ে আসা হলে তিনি কোম্পানি ছেড়ে দেন এবং আলেক্সেন্ডার ম্যাল্কমসনের সাথে কাজ শুরু করেন।
তাঁরা দুজন মিলে আবারো নতুন বিনিয়োগ- কারী খুঁজে বের করেন এবং ১৯০৩ সালে ফোর্ড মোটর কোম্পানি নতুন করে শুরু করেন।
অটোমোবাইল বিশ্বের প্রথম প্রভাবশালী গাড়ি। হেনরি ফোর্ড এই গাড়িটি ১৯০৮ সালে বাজারজাত শুরু করেন । এরপর থেকেই আমেরিকান মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে চলে আসে গাড়ি।
বিলাসবহুল পণ্য থেকে গাড়িকে নিত্য প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য জিনিষে রূপান্তর করাতে, এই মডেলের গাড়িটি বহুল জনপ্রিয়। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত, ১৬ বছর
ধরে মডেল টি ব্যাপক সফলতা অর্জনের পর তিনি নতুন একটি গাড়ি ‘মডেল এ’
নিয়ে কাজ শুরু করেন।
এই গাড়িটি হেনরি বাজারে আনেন ১৯২৭ সালে। ফোর্ডের মডেল ‘ টি ‘ দুই দশক ধরে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মডেল টি বাজারজাত হয়েছিল যা এখনো নিলামে বিক্রি হয়। আর মডেল ‘ এ ‘ বাজারজাত হয়েছিল প্রায় চল্লিশ লক্ষ ইউনিট। এই দুই মডেলের গাড়ি মূলত হেনরি ফোর্ডকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যায়।
ব্যক্তিগত জীবন এবং মানবতাঃ
ব্যাক্তিগত জীবনে ফোর্ড ক্লারা ব্রায়ান্টের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৮৯৩ সাথে তাঁদের ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। মানবিক গুণাবলীর দিক দিয়েও হেনরি ফোর্ড একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
তিনি নিজে মিথ্যে বলা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁর আশেপাশে সবাইকেও সব সময় সত্য বলার জন্য পরামর্শ দিতেন। তিনিই তৎকালীন আমেরিকার একমাত্র ব্যক্তি যার কোম্পানিতে শ্রমিকের মুজুরি ছিল ৫ ডলার।
অর্থাৎ বলা যায় তিনি তার কোম্পানিতে চাকরি করা শ্রমিকদের প্রতিও সদয় ছিলেন। তাঁর কোম্পানির চাকরিজীবীদের জন্য স্কুল কলেজ, কল্যাণ ফান্ড সহ আরো উন্নয়ন- মূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।
তাঁর গড়া ফোর্ড ফাউন্ডেশন এখনো নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব যুদ্ধের সময়, দাঙ্গা ফ্যাসাদ থামানোর জন্যও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
হেনরি ফোর্ডের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ”পৃথিবীর জন্য কিছু করলে ,পৃথিবীও তোমার জন্য কিছু করবে।”
কেবল নিজ ইচ্ছাশক্তি এবং কজের মাধ্যমে একজন মানুষ কীভাবে শিকড় থেকে শেখরে উঠতে পারে, হেনরি ফোর্ড তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
আমাদের জীবনে যানবাহন একটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ। আর যানবাহনকে মানুষের জন্য উন্নত করে গড়ে তোলা এবং বিশ্ব অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিকে এক কথায় বৈশ্বিক রূপদান করার জন্য হেনরি ফোর্ডের নাম মানব ইতিহাসে চিরদিনের জন্য লিখা থাকবে।
৬৩ সালে আমেরিকার মিশিগানে জন্ম নেয়া হেনরি ফোর্ড হলেন বিশ্ব বিখ্যাত গাড়ির কোম্পানী ফোর্ড মোটরস এর প্রতিষ্ঠাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে লাভজনক গাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠানের একটি।
বেঁচে থাকতেই হেনরি ফোর্ড তাঁর কোম্পানীকে সফল করে গেছেন, এবং নিজেও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং সফল মানুষদের একজন হয়েছেন।
যদিও তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন ধরা হয় – প্রথম দিকে তিনি আসলে একজন ব্যর্থ মানুষ ছিলেন।
সত্যি কথা বলতে, ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি অন্যের চাকরি করেছেন। ১৮৯৮ সালে তিনি একটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ইঞ্জিন বানিয়ে সবাইকে দেখান এবং উইলিয়াম এইচ. মার্ফি নামে একজন ধনী ব্যক্তির বিনিয়োগ পান।
পরের বছর ফোর্ড তাঁর প্রথম গাড়ির কোম্পানী “ডিট্রয়েড অটোমোবাইল কোম্পানী” প্রতিষ্ঠা করেন (ফোর্ড মোটরস নয়)।
১৯০১ সালে কোম্পানীটি ব্যর্থ হয়। লোনের টাকা শোধ করতে না পারা এবং গাড়ির ডিজাইনে ঝামেলা থাকায় প্রজেক্টটি সফল হয়নি। কোম্পানী তাদের কাজ বন্ধ করার কিছুদিন পর ফোর্ড একজন বিনিয়োগ- কারীকে আর একবার চেষ্টা করতে রাজি করাতে পারেন।
কিন্তু এটাও অল্প কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। কারণ বিনিয়োগকারীরা কোনও বিষয়েই একমত হতে পারছিলেন না।
অবশেষে ১৯০৩ সালে ৪০ বছর বয়সী ফোর্ড তাঁর নিজের নামে কোম্পানী শুরু করেন।
এবার তিনি নতুন বিনিয়োগকারী স্কটিশ কয়লা ব্যবসায়ী ম্যালকমসনকে রাজি করান যে সে ব্যবসায়ে নাক গলাবে না। শুধু তাঁর লাভের টাকা বুঝে নেবে। এরপর ফোর্ড তাঁর নিজের মত কাজ করতে শুরু করেন।