অ্যাজমা বা হাঁপানি

অ্যাজমা বা হাঁপানিঃ

দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এবং সংবেদনশীলতায় স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় যাকে বলে হাঁপানি বা
অ্যাজমা । অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট এমন একটা রোগ যার নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা না গেলেও চিহ্নিত করা হয়েছে প্রধানতঃ ২ টি কারণকে।
১) ‘এটোপি’ বা বংশগত (Genetic) ও ‘এলার্জি’ পরিবেশগত উপাদান এবং
২) শ্বাসনালীর অতি-সক্রিয়তা (Bronchial hyper-responsiveness)।
পৃথিবীজুড়ে ৩০ কোটি লোক অ্যাজমায় আক্রান্ত, যা ২০২৫ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ কোটিতে পৌছবে । বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ । যার মধ্যে ৪০ লাখই শিশু । ৬৫% মানুষের আক্রান্ত হবার কারণ এলার্জি । যুবক বয়সে অ্যাজমা আক্রান্তের হার ১৫% । পেশাগত ভাবে ‘potent sensitizer’ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫-২০% এজমায় আক্রান্ত হয় ।
অ্যাজমা রোগের লক্ষণ চেনার উপায়ঃ

  • শ্বাসকষ্ট, সাথে শুকনো কাশি ।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাঁশির মতো সাঁ সাঁ শব্দ ।
  • হঠাৎ দমবন্ধ ভাব অনুভব করা ।
  • ধুলোবালি বিশেষভাবে ঘরের ধুলো, ঠাণ্ডা কিংবা গরমের কারণে শুকনো কাশি এবং শ্বাসকষ্ট ।
  • ঋতু পরিবর্তনের সময় শ্বাসকষ্ট ।
  • বিটাব্লকার বা অ্যাসরিন জাতীয় ওষুধ খেলে শ্বাসকষ্ট । চিকিৎসার জন্য দরকার প্রথমেই রোগ নির্ণয় । রক্ত পরীক্ষায় বিশেষত ইয়োসিনোফিল এবং সিরাম আইজিইয়ের মাত্রা বেশি আছে কিনা দেখা হয় অ্যাজমা নির্ণয়ে এবং এলার্জির জন্য স্কিন প্রিক টেস্ট করা হয় । এ পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার ওপর বিভিন্ন এলারজেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এ পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে রোগীর এলার্জি আছে তা ধরা পড়ে । বুকের এক্স-রে করে দেখা হয় যে, অন্য কোন কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট কি না তা জানতে । কিছু কিছু বিষয়ে সচেতনতা হাঁপানি থেকে দূরে রাখে ।
    ১. এলাজেন পরিহারঃ অ্যাজমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো যে জিনিসে এলার্জি তা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা । তাই এজমা রোগীদের প্রথমেই এলার্জি টেস্ট করে জানা দরকার তার কিসে কিসে এলার্জি হয় ।
    ২. ওষুধপত্রঃ নানা ধরনের হাঁপানির ওষুধ আছে । প্রয়োজন মতো ওষুধ ব্যবহার করে রোগী সুস্থ থাকতে পারেন । সাধারণতঃ দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় ।
    ক) শ্বাসনালির সঙ্কোচন বন্ধ করতে ওষুধ ব্যবহার করা, যেমন ব্রঙ্কোডাইলেটর, নালবিউটামল, থিউফাইলিন, ব্যামবুটারল
    খ) প্রদাহ নিরাময়ের ওষুধ, যেমন কার্টিকোস্টেরয়েড (বেকলোমেথাসন, ট্রাইএমসিনোলোন, ফ্লোটিকাসন) এগুলো ইনহেলার, রোটাহেলার, একুহেলার ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং লিউকোট্রাইন নিয়ন্ত্রক মন্টিলুকাস্ট , জেফিরলুকাস্ট ব্যবহার করা ।
    ৩. এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপিঃ এলার্জি দ্রব্যাদি থেকে এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিন ও অ্যাজমা রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি । এ পদ্ধতি ব্যবহারে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার অনেক কমে যায় । ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও রেহাই পাওয়া যায় । বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে । বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ভ্যাকসিন পদ্ধতি চিকিৎসাকে এজমার অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করে । এটাই অ্যাজমা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি । বর্তমানে বাংলাদেশেও এ পদ্ধতিতে চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হয় ।
    প্রতিকারের উপায়ঃ
    ১. এলার্জি কারক বস্তু এড়িয়ে চলুন । যেমনঃ ধুলো, বালি, ঘরের ঝুল, ধোঁয়া ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন ।
    ২. ঘর বাড়িকে ধুলো বালি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা । এজন্য দৈনিক অন্ততঃ একবার ঘরের মেঝে, আসবাপত্র, ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে হবে অথবা ভ্যাকিউম ক্লিনার ব্যবহার করা ।
    ৩. ঘরে কার্পেট রাখবেন না ।
    ৪. বালিশ, তোষক, ম্যাট্রেসে তুলা ব্যবহার না করে স্পঞ্জ ব্যবহার করা ।
    ৫. শীতকালে যথা সম্ভব গরম পানিতে গোসল করা ।
    ৬. ধূমপান করবেন না ।
    ৭. যেসব খাবারে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা পরিহার করে চলুন ।
    ৮. ঠাণ্ডা খাবার, আইসক্রিম ইত্যাদি খাবেন না ।
    ৯. মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তাকে ইতিবাচক মনোভাবে মানিয়ে চলুন । কিংবা মানসিক চাপের কারণকে এড়িয়ে চলুন ।
    ১০. পেশাগত কারণে অ্যাজমা হলে চেষ্টা করতে হবে স্থান কিংবা পেশা পরিবর্তন ।
    ১১. পরিশ্রম কিংবা খেলাধুলার কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়লে চেষ্টা করতে হবে পরিশ্রমের কাজ কম করতে ।
    ১২. সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করবেন । ইতিবাচক মন আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে ।
    ১৩. রেণু পরিহারে সকাল কিংবা সন্ধ্যা বাগান এলাকায় কিংবা শস্য ক্ষেতের কাছে যাবেন না ।
    ১৪. রেণু এলাকা থেকে বাসায় ফিরে মাথার চুল ও কাপড় ধুয়ে ফেলুন ।
    ১৫. শহরে হাঁপানি রোগীরা বেশি সাবধান থাকবেনঃ
    হাঁপানির অন্যতম একটি কারণ দূষন।
    বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতালে যত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তার ৩০ শতাংশ হাঁপানি রোগী এবং প্রতিবছর সংখ্যাটি বাড়ছে। বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন প্রতি দশ বছর অন্তর শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সম্পর্কিত জরিপ পরিচালনা করে থাকে। তাতে দেখা গেছে ১৯৯৯ সালে দেশে ৭০ লাখ হাঁপানি রোগী ছিল। তার ১০ বছর পর রোগীর সংখ্যা আরো ২০ লাখ বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সালের জরিপটি পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
    কিন্তু শহরাঞ্চলে হাঁপানি অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
    হাঁপানির লক্ষণগুলো কী?
    হাঁপানির প্রাথমিক চারটি লক্ষণঃ
    আপনার যদি মাঝে মাঝেই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নিঃশ্বাসের সাথে সাঁ সাঁ শব্দ শুনতে পান, সেই সাথে শুকনো কাশি, প্রায়শঃই এই কাশি একটানা অনেকক্ষণ ধরে চলে, বুকে চাপ অনুভব করা এবং খুব অল্প পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে যাওয়া- এই লক্ষণগুলো যদি থাকে তাহলে আপনি সম্ভবত হাঁপানিতে আক্রান্ত । এসব সমস্যা লক্ষ্য করলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ারা পরামর্শ দেয়া হল।
    হাঁপানি বংশগত হতে পারে আবার পরিবেশগত কারণেও হতে পারে। তবে ইদানীং পরিবেশগত কারণটিই বেশি দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক যে কারো হাঁপানি হতে পারে।
    শহরে হাঁপানি বৃদ্ধির অন্য কারণগুলোর একটি ঘনবসতি।
    শহরে হাঁপানি কেন বেশি হচ্ছেঃ
    শহর অঞ্চল, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং যেখানে নগরায়নের প্রক্রিয়া চলছে সেখানে হাঁপানি বেশি হচ্ছে বলে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
    অ্যাজমা ইউকে বলছে বায়ু দূষণ হাঁপানির সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। “শহরে পরিবেশ দূষণ বেশি থাকে। ধুলো, ধোয়ার মতো পরিবেশ দূষণের কারণে ফুসফুসের এই রোগটি দ্রুত প্রকাশিত হয়। যাদের হাঁপানি রোগটি আছে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি ভুগে থাকেন। যাদের কম সমস্যা রয়েছে তাদের হাঁপানি বেড়ে যেতে পারে।”
    শহরে হাঁপানি বৃদ্ধির অন্য কারণগুলোর একটি ঘনবসতি। শহরে বহু মানুষকে খুব ঘিঞ্জি ঘরে বসবাস করতে হয় যা ঘরের ভেতরের পরিবেশকে স্যাঁতসেঁতে ও অস্বাস্থ্যকর করে তোলে।
    ঘরের কোনায়, আসবাবের তলায় জমে থাকা ধুলো এবং সেই ধুলোয় ‘ডাস্ট মাইট’ নামে এক ধরনের কীট বেশি তৈরি হয়। ধুলো এবং এই কীট হাঁপানি বাড়িয়ে দেয়।
    রান্না থেকে যে ধোঁয়া তৈরি হয় তাতেও ঘরের ভেতরে পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে। শহরে বদ্ধ ঘরে রান্নার ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য ব্যবস্থা থাকে না, যা বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আক্রান্ত করে।
    গ্রামাঞ্চলে পরিবেশ খোলামেলা হওয়ার কারণে এসব সমস্যা কম হয়ে থাকে।
    পরিবেশ দূষণের কারণে ফুসফুসের এই রোগটি দ্রুত প্রকাশিত হয়।
    নগরীতে মানুষের জীবনযাপনে যে পরিবর্তন দেখা দেয়, যেমন টাটকা খাবারের বদলে অনেক কৃত্রিম খাবার শরীরে প্রবেশ করে। শহরে ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রমও কমে যায়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে দূষণের পাশাপাশি খেলাধুলার জয়গার অভাব, ঘরে বন্দি জীবন তাদের ফুসফুসের সবল বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। দুর্বল ফুসফুসে হাঁপানির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
    গাড়ির দূষণ রয়েছে, প্রচুর নির্মাণকাজ চলছে এমন জায়গায় গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
    দিনের যে সময়ে যে এলাকায় দূষণ বেশি হয় সে সময়টি বাইরে যাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে।
    ঢাকার কিছু এলাকায় সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বায়ু দূষণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। ঘর-দোর নিয়মিত পরিষ্কার করা, ঘরে কাগজপত্র জমিয়ে না রাখা, বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা। কিছু টিকা রয়েছে যা নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে দেয়া হয়ে থাকে। সেগুলো হাঁপানি প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
    সুষ্ঠু জীবনযাপন, ভাল খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ধূমপান পরিত্যাগ-এই কয়েকটি বিষয়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *