ফুড পয়জনিং হলে কী করবেন

আমাদের দেশে ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া একটি পরিচিত সমস্যা। কারণ, প্রায়ই বাইরের বা হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার অপরিষ্কার ও জীবাণুযুক্ত হয়ে থাকে। যখন কেউ দূষিত, নষ্ট বা বিষাক্ত খাবার খায়, যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং পরজীবী দ্বারা সংক্রামিত, তখন ফুড পয়জনিং হয়ে থাকে। প্রবীণ ও শিশুদের জন্য সমস্যাটি প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ শিশু মৃত্যু খাবারে বিষক্রিয়া জনিত কারণে হয়ে থাকে।

লক্ষণ কীঃ

ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা, ক্ষুধা মান্দ্য, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, ক্লান্তি, জ্বর বোধ করা, মাথা ব্যথা—এ গুলো ফুড পয়- জনিংয়ের লক্ষণ। সাধারণতঃ দূষিত খাবার গ্রহণের ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যদি ১০১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি জ্বর, তিন দিনের বেশি ডায়রিয়া, তীব্র পানি শূন্যতা, দৃষ্টি ঝাপসা, চেতনা কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ থাকে।

কাদের ঝুঁকি বেশিঃ

শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে খাদ্যে বিষ- ক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ, এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিপাক এবং বিভিন্ন পরিবর্তন খাদ্যে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। যকৃতের রোগ, এইডস এবং ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘ স্থায়ী রোগ গুলো শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই তাদের ঝুঁকি বেশি।

জটিলতা কি হতে পারেঃ

তীব্র পানি শূন্যতা সব চেয়ে ভয়ংকর জটিলতা। গর্ভাবস্থায় খাদ্যে বিষক্রিয়া হলে সমস্যা বেশি জটিল হয়। ই.কোলি ব্যাকটে- রিয়া প্রজাতি হেমোলিটিক ইউরেমিক সিন- ড্রোম নামক মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া প্রাপ্ত বয়স্ক, দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এই জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

রোগ নির্ণয়ঃ

আক্রান্ত ব্যক্তির ইতিহাস শুনে, কত দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন, বিভিন্ন লক্ষণ এবং যে খাবারগুলো খেয়েছেন তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন চিকিৎ- সক। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ক্ষেত্রে কী দায়ী, তা নির্ধারণ করতে মল এবং রক্ত পরীক্ষা করা যায়। এ ছাড়া পাতলা পায়খানার জটিলতা দেখতে কিডনি, রক্তের লবণ ইত্যাদি পরীক্ষা করতে হয়।

চিকিৎসা কীঃ

খাদ্যে বিষক্রিয়া হলে বাড়িতেই চিকিৎসা করা যেতে পারে। সাধারণতঃ তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ইহা ভালো হয়ে যায়। নিজেকে সারাক্ষণ হাইড্রেটেড রাখুন। শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে ইলেকট্রো- লাইটযুক্ত পানি পান করুন। পানিশূন্যতা তীব্র হলে শিরার মাধ্যমে স্যালাইন দিতে হবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়রিয়া প্রতিরোধী ঔষধ গ্রহণ করা যেতে পারে। যদিও ইহা শুধু প্রয়োজনেই ব্যবহার করা উচিত। কারণ, ডায়রিয়া শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। তাই নিজে নিজে বা দোকানির পরামর্শে ডায়রিয়া বন্ধ করার ঔষধ খাবেন না। অনেক সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের প্রয়ো- জন পড়তে পারে। সংক্রামিত ব্যাকটেরিয়া অনেক সময় এমন টক্সিন উৎপন্ন করে সহজে যা শরীর থেকে দূর করা কঠিন। এ অবস্থায় বিষক্রিয়া নিষ্ক্রিয় করতে অ্যান্টি- টক্সিন ঔষধ দিতে পারেন ডাক্তার।
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সময় আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে জন্য বিশ্রাম খুব উপকারী। ফুড পয়জনিংয়ের সময় নিয়মমতো খাওয়া ও বিশ্রাম দ্রুত সেরে ওঠার জন্য সহায়ক।

কী খাব

ফুড পয়জনিং বা খাদ্য বিষক্রিয়ার সময় খাদ্য তালিকায় রাখুন কলা, ভাত, মুরগির পাতলা ঝোল, সেদ্ধ শাক সবজি, টোস্ট, ফলের রস বা ডাবের পানি। এড়িয়ে চলুন চর্বি যুক্ত খাবার, দুগ্ধজাত খাবার, মসলাদার এবং ভাজা খাবার, উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার আর ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়।

ঘরোয়া প্রতিকারঃ

ফুড পয়জনিং হলে প্রতি দিন কুঁচি আদার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মধু খেতে পারেন, হজম শক্তি বাড়বে ও পেট ব্যথা কমবে। পেট খারাপ, পেট ব্যথার মতো সমস্যা নিমেষে ঠিক করে দিতে পারে এক চা-চামচ জিরার গুঁড়ো।

তুলসী পাতা থেঁতো করে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুফল পাবেন। কলাতে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে, যা ফুড পয়জনিং কমাতে সাহায্য করে। একটা কলার সঙ্গে আপেল গ্রেট করে বা এক গ্লাস বানানা শেক খেলেও উপকার পাবেন।

যে সব ব্যাকটেরিয়ার জন্য ফুড পয়জনিং হয়, লেবুর রসের অ্যাসিডিটিতে তার প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। একটা গোটা পাতি লেবুর রসের সঙ্গে সামান্য চিনি দিয়ে খেতে পারলে খুব তাড়া তাড়ি উপকার হয়। ফুড পয়জনিংয়ের সময় ডিহাইড্রেশনের সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই বেশি পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

ডা. এ টি এম রফিক উজ্জ্বল: রেজিস্ট্রার, শিশুরোগ বিভাগ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, ঢাকা

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *