মৃগী(Epilepsy) রোগ
– মৃগী রোগ – যাতে খিঁচুনি হয় নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক রোগ ।
– এই রোগের প্রকৃত কারণ জানা না
গেলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় মস্তিষ্কে আঘাত,স্ট্রোক, মস্তিষ্কে টিউমার বা সংক্রমণ, জন্মগত ত্রুটি প্রভৃতিকে ।
– কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়ী জিনগত মিউটেশন বলে মনে করা হয়।
– খিঁচুনি হয় মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সের স্নায়ুকোষ সমূহের অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলে ।
– বার বার স্নায়বিক কারণে ফিট অর্থাৎ হঠাৎ খিচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাবার রোগ । এক প্রকার মস্তিষ্কের রোগ এটি ; চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে “নিউরোলো- জিক্যাল ডিজিজ” বলা হয় । এই রোগ দেখা দেয় মানব মস্তিষ্কের কার্য প্রণালীতে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে । ঊনবিংশ শতাব্দীতে গবেষকদের ধারণা ছিল মৃগী রোগ থাকলেই ব্যক্তির বুদ্ধি-বিচার-বিবেচনা বোধের উৎকর্ষ কমে যায় । কিন্তু বর্তমানে গবেষকরা মনে করেন, মৃগী রোগে আক্রান্তদের খুব কম অংশে বিচার-বুদ্ধি মত্তার ঘাটতি দেখা যায়।
মৃগীরোগের লক্ষণ ও চিকিৎসাঃ
মৃগী স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা জনিত একটি রোগ। ৪০টিরও বেশি নিউরোলজিক্যাল রোগের মধ্যে সাধারণ একটি লক্ষণ হলো খিঁচুনি। সাধারণতঃ মস্তিষ্কের কোষগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সচল রাখে। কোনো কারণে মানব দেহের কার্য পরিচালনাকারী মস্তিষ্কের স্নায়ু তন্ত্রের উদ্দীপক ও নিবৃত্তি কারক অংশ দ্বয়ের কার্য প্রণালির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মৃগী রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
সুস্থ–স্বাভাবিক একজন ব্যক্তি যদি হঠাৎ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপুনি বা খিঁচুনির শিকার হন, চোখ-মুখ উল্টে ফেলে কিংবা কোনো শিশুর চোখের পাতা স্থির হয়ে যায়, এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অথবা মানসিক ভাবে সুস্থ কোনো ব্যক্তি যদি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন, তবে তাঁকে মৃগীরোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিশ্বে পাঁচ কোটি মানুষের মৃগী রোগ আছে, যার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই থাকে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশে।
মৃগীর প্রধান চ্যালেঞ্জঃ
মৃগীরোগের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় একটি বিষয়। এখানেই এই অবস্থাকে ঘিরে সামাজিক বিষয় বা নিষিদ্ধ, কল্পকাহিনি সহ অনেক ভুল ধারণা রয়েছে । কখনো কখনো এই অবস্থার চিকিৎসা নির্ণয় সঠিক নয়, যা ভুল বা বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে সমস্যার কারণ হতে পারে। অনেক সময় বলা হয়, এটা ভূত প্রেত বা দুষ্ট আত্মা দ্বারা সৃষ্ট । এটা সত্য নয়। এর সঙ্গে অতীত জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই । এটি একটি বৈজ্ঞানিক স্নায়বিক বিষয়, যা সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
এপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডি অব এপিলেপ্সি নির্দেশ করে যে সামগ্রিকভাবে মৃগীরোগের প্রকোপ নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে সামান্য বেশি।
মৃগী রোগ যে কারণে হয়ঃ
মৃগীরোগ হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ নেই এবং শতকরা ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে কোনো কারণ বের করা সম্ভব হয়নি ।
তবে নিম্নোক্ত কারণগুলো থেকে মৃগীরোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকেঃ
– জন্মের আগে বা জন্মের সময় বা পরে মস্তিষ্কে আঘাত।
আঘাত এবং মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব।
– সংক্রমণ যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে।
– মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে প্রতিবন্ধকতা (স্ট্রোক বা অন্যান্য সমস্যা)।
– মেহজমের সমস্যা বা পুষ্টির অভাব।
– মস্তিষ্কের টিউমার।
– অধিক মাত্রার জ্বর।
– মস্তিষ্কে প্রদাহ।
– এ ছাড়া অন্যান্য রোগ।
৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মৃগীরোগ জেনেটিক প্রবণতা দ্বারা সৃষ্ট । উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মৃগী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রথম পর্যায়ের আত্মীয়দের মৃগী রোগের ঝুঁকি
দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায়।
মৃগীরোগের লক্ষণঃ
৪০ ধরনের মৃগীরোগ হতে পারে । মৃগী রোগীর মধ্যে নিম্নলিখিত যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিতে পারেঃ
– হঠাৎ শরীরের কোনো অংশে খিঁচুনি শুরু হওয়া ও পর্যায়ক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া।
– হঠাৎ নমনীয় ভাবে ঢলে পড়া।
– শরীর শক্ত হয়ে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাওয়া।
– হঠাৎ জ্ঞান হারানো।
– ঘন ঘন কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া।
– ছোট বাচ্চাদের শরীর হঠাৎ ঝাঁকি খাওয়া।
– হঠাৎ মাথা বা পিঠ কিংবা পুরো শরীর সামনে ঝুঁকে আসা।
– হাত থেকে হঠাৎ করে কিছু ছিটকে পড়া।
– হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করা এবং হাত, পা ও মুখের অস্বাভাবিক নড়া চড়া
শুরু হওয়া।
– হঠাৎ শরীরের কোনো অংশে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া।
মৃগীরোগের ডায়াগনোসিসঃ
– রোগী এবং প্রত্যক্ষকারীর বিস্তারিত ইতিহাস।
– রক্ত পরীক্ষা।
– ইইজি।
– মস্তিষ্কের এমআরএই এবং সিটি স্ক্যান।
– সিএসএফ পরীক্ষা।
খিঁচুনির সময় যা করা যাবে নাঃ
– আতঙ্কিত বা ভীত হওয়া যাবে না।
– খিঁচুনির সময় কোনো রূপ বাধা সৃষ্টি বা রোগীকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা যাবে না; এতে রোগী ও সাহায্য কারী উভয়ই আহত হতে পারে।
– রোগীর মুখে চামড়ার জুতো বা চামড়ার তৈরি অন্য কিছু, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরা উচিত হবে না। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে।
– রোগী পুরোপুরি সচেতন না হওয়া পর্যন্ত পানি বা অন্য কোনো পানীয় দেওয়া যাবে না।
– সাধারণতঃ খিঁচুনি দুই মিনিটের বেশি
স্থায়ী হয় না এবং এরপর রোগী গভীর
ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
কখন চিকিৎসার প্রয়োজনঃ
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে রোগীকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
• খিঁচুনির স্থায়িত্ব পাঁচ মিনিটের বেশি হলে।
• রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হলে।
• রোগী একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে বিভ্রান্ত হয়ে থাকলে কিংবা অচেতন থাকলে।
• খিঁচুনির সময়ে রোগী কোনো ভাবে আহত হলে।
• রোগী প্রথম বারের মতো মৃগীতে আক্রান্ত হলে বিস্তারিত জানার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগ বা কোনো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
মৃগীরোগের চিকিৎসাঃ
মৃগীরোগের চিকিৎসা প্রধানতঃ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল;
যেমনঃ অ্যান্টি-এপিলেপটিক ঔষধ ,
অ্যান্টি-এপিলেপটিক ঔষধ গুলোর সাধারণতঃ পছন্দসই চিকিৎসা ব্যবস্থা । প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ৭০ শতাংশ ঘটনায় ঔষধ দিয়েই উপসর্গ গুলো বা খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় করা গিয়েছে। মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত হওয়া রাসায়নিক গুলোর পরিমাণ পরিবর্তন করে এই ঔষধ গুলো খিঁচুনির তীব্রতা ও পুনরা বৃত্তির হার হ্রাস করতে সাহায্য করে। যদিও এই ঔষধ গুলো মৃগী রোগের নিরাময় করতে পারে না, কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসায় খিঁচুনির ঘটনার পুনরাবৃত্তির হার হ্রাস করে। এই ঔষধ গুলো বিভিন্ন ধরনের পাওয়া যায়।
চিকিৎসার শুরুতে ঔষধ অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করা হয় এবং খিঁচুনির ঘটনা না থামা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ঔষধের মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়। কোনো অর্থ পূর্ণ প্রতিক্রিয়া বা উন্নতি না দেখা গেলে চিকিৎসক ঔষধ পরিবর্তন করতে পারেন। মৃগী রোগের ধরনের ওপরে ঔষধের ধরন নির্ভর করে এবং শুধু একজন চিকিৎসকই এই ঔষধ গুলো প্রেসক্রাইব করতে পারেন। রোগী যদি অন্য কোনো ওষুধ নিতে থাকেন, তাহলে ডাক্তারকে তা জানাতে হবে।
কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ তা ডাক্তারকে জানাতে হবে। সুতরাং , যেভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ঔষধগুলো ঠিক সেই ভাবেই সেবন করতে হবে। ঔষধের মাত্রা পরিবর্তন করার আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। রোগীর মেজাজের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলে ডাক্তারকে তা জানাতে হবে।
শল্য চিকিৎসাঃ
ঔষধে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে না এলে অথবা বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে শল্য চিকিৎসা করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। অস্ত্রোপচারের সময় মস্তিষ্কের প্রভাবিত অংশ বাদ দেওয়া হয় । অস্ত্রোপচার তখনই করা হয়, যখন মস্তিষ্কের খুব ছোট এলাকা প্রভাবিত হয় এবং সেই এলাকা শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেমনঃ বাক্ শক্তি, শ্রবণশক্তি, চলাফেরা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের
নড়া চড়া ও সমন্বয় ইত্যাদির কোনো ক্ষতি করে না।
এ ছাড়া কিটো-জেনিক ডায়েট, ইপিলেপসি সার্জারি,ভেগাল নার্ভ স্টিমুলেশন (ভিএনএস) , রেসপন্সিভ নার্ভ স্টিমুলেশন (আরএনএস) স্টেরিওট্যাকটিক সার্জারি ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এসব চিকিৎসা সাধারণতঃ উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে।
জীবনধারার ব্যবস্থাপনাঃ
খিঁচুনির নিয়ন্ত্রণ জরুরি কারণ এটি বিপজ্জনক এবং জটিল সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
– নিয়মিত ঔষধ সেবন করা । ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া ঔষধ বন্ধ কর যাবে না।
– খিঁচুনি বা মৃগী রোগ শুরুর কারণ খুঁজে বের করুন। খুব সাধারণ কারণগুলো হলো নিয়মিত ঔষধ না খাওয়া, মানসিক চাপ, খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম, মদ্যপান, অনিদ্রা, উজ্জ্বল আলো, জোরে আওয়াজ ইত্যাদি খিঁচুনি সৃষ্টি করে।
– খিঁচুনি কবে ও কখন শুরু হলো- এর তীব্রতা কত, কতক্ষণ ধরে হয়েছে এবং তার সঙ্গে খিঁচুনি শুরুর আগে আপনি কী করছিলেন, তা বিস্তারিত লিখে রাখুন।
– খিঁচুনি শুরুর কারণ গুলোকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করার নিয়মঃ
১. নিয়মিত ঔষধ সেবন করা।
২. খাওয়া দাওয়া সময় মতো করা।
৩. ঘুমানোর জন্য তাড়া তাড়ি শুয়ে পড়ার চেষ্টা করা।
৪. শ্বাসের হালকা ব্যায়াম করা।
৫. মদ্য পান না করা।
৬. নেশা জাতীয় ঔষধ সেবন না করা।
– খিঁচুনি খুব ঘন ঘন হলে গাড়ি চালানো, সাঁতার কাটা এবং রান্না করা যাবে না। কারণ, এগুলো করার সময় খিঁচুনি হলে তা খুবই ক্ষতি কারক হবে।
– বাড়ির আসবাব পত্র গুলোর কোণ মসৃণ হতে হবে।
– স্নান করার সময় স্নান ঘরের দরজা বন্ধ করা যাবে না।
– বাথ টাবে স্নান করার বদলে শাওয়ার ব্যবহার করতে হবে। এতে খিঁচুনি শুরু হলে বাথ টাবে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
– সাঁতার কাটার সময় এমন সঙ্গী সঙ্গে রাখুন, যিনি আপনার খিঁচুনি শুরু হলে আপনাকে উদ্ধার করতে পারবেন।
– ঘরের বাইরে কোনো খেলা ধুলার সময় মাথায় হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।
খিঁচুনিতে আক্রান্ত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
– আক্রান্ত রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে দিতে হবে এবং গায়ের কাপড় খুলে দিতে হবে।
-আশপাশের ধারালো জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
– রোগীকে এক পাশে করে শোয়াতে হবে যাতে করে লালা বা থুতু মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
– মাথার নিচে নরম কাপড় ভাঁজ করে দিতে হবে।
– রোগীর মুখে কোনো কিছু দেওয়া যাবে না।
– খিঁচুনির পরে রোগীকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম বা ঘুমাতে দিতে হবে।
মৃগীরোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষ সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবা নিলে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন ।
মৃগীরোগ প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য একটি অসুখ—এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে । মৃগীরোগ নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে প্রয়োজন সচেতনতা।
মৃগীরোগ মস্তিষ্কের স্নায়ু তন্ত্রের একটি রোগ। এটি প্রতিরোধ ও চিকিৎসা যোগ্য। দ্রুত শনাক্ত হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চললে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগটি ঔষধে নিরাময় হয় । তবে এ রোগ নিয়ে ভূতের আসর, জিনে ধরেছে, অভিশাপ—এ ধরনের নানান কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত আছে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই ।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, রোগটি প্রতিরোধ যোগ্য ও চিকিৎসা যোগ্য একটি অসুখ । বংশগত মৃগী রোগ প্রতিরোধ করা যায় না। তবে শিশুর জন্মকালীন জটিলতার কারণে মস্তিষ্কে আঘাত সহ নানা কারণে মৃগী রোগ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। রোগীকে সামাজিক ভাবে আলাদা করে রাখা, অবহেলা করাকে অপরাধ হিসেবেই উল্লেখ করা হয় । মৃগী রোগীকে কবিরাজের কাছে না নিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা করানোর জন্য সবার প্রতি অনুরোধ ।
রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা খুব জরুরি। খিঁচুনি হলে রোগী অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না । খিঁচুনির সময় যিনি পাশে ছিলেন, তাকে রোগীর খিঁচুনির সময়ের পুরো ঘটনা চিকিৎসকের কাছে বর্ণনা করতে হবে । একবার খিঁচুনি হয়েছে না বার বার হয়েছে, তা জানাতে হবে। এসব ইতিহাস জানার পাশা পাশি ইইজি, এমআরআই সহ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করেন চিকিৎসকেরা।
স্বজনদের করণীয়ঃ
মৃগীরোগের ক্ষেত্রে খিঁচুনি এক থেকে দুই মিনিট স্থায়ী হয়। খিঁচুনির সময় রোগীর তেমন কোনো করণীয় থাকে না। যিনি পাশে থাকেন, তাঁকে রোগীর চোখে চশমা বা অন্য কিছু যা দিয়ে ব্যথা পেতে পারে এমন কিছু থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে । আঁটসাঁট পোশাক থাকলে তা ঢিলে করে দিতে হবে। ঝাঁকুনির সময় রোগীর মাথার নিচে বালিশ বা কুশন দিতে হবে, যাতে মস্তিষ্কে আঘাত না লাগে। রোগীকে কাত করে শোয়াতে হবে। রোগীর পাশে যিনি থাকবেন , তাঁকে আতঙ্কিত হলে চলবে না। রোগীকে শক্ত করে ধরে না রাখা, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত পানি বা অন্য কোনো খাবার না খাওয়ানো, দাঁত কামড় দিয়ে থাকলে মুখ খোলার চেষ্টা করা যাবে না। কুসংস্কারের ফলে রোগীকে জুতা শোঁকানো হয়, এটা একেবারেই করা যাবে না । প্রথমবার খিঁচুনি এবং খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে, আধা ঘণ্টার মধ্যে রোগীর জ্ঞান না ফিরলে, খিঁচুনির সঙ্গে অন্য কোনো জটিল অসুখ থাকলে বা খিঁচুনির সময় আঘাত প্রাপ্ত হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বন্ধ করে দিলে বা নিয়মিত না খেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে । একই ভাবে ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলে , তা আগে থেকেই বলে দিতে হবে। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার বেশি রাখা, ধূমপান বা মদ না খাওয়া, রোগটি নিয়ন্ত্রণ হওয়ার আগে চালক, পাইলট এ ধরনের পেশায় যোগ না দেওয়া সহ নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
নারীদের জন্য বাড়তি সচেতনতাঃ
মৃগীরোগ নারীদের মাসিক থেকে শুরু করে সন্তান নেওয়া সহ বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলতে পারে । মৃগী রোগ হলেও সন্তান ধারণ, স্বাভাবিক প্রসব সবই সম্ভব। শুধু সন্তান নেওয়ার কমপক্ষে ছয় মাস আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। শুধু বাচ্চা গর্ভে আসার আগে থেকে এবং সন্তান প্রসবের পর অর্থাৎ পুরো সময় চিকিৎসকের মনিটরিংয়ে থাকতে হবে। বাচ্চা বিকলাঙ্গ যাতে না হয়, সে জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা ওষুধ পাল্টে দেন। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকলে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতেও কোনো বাধা নেই।
শিশুদের ঝুঁকি বেশিঃ
বড়দের তুলনায় শিশুদের (জন্মের সময় জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণ) মৃগী রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি । জন্মের পর এক মাস বয়স থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে। তবে বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এ রোগ বেশি হয়।
শিশুর মৃগীরোগ শনাক্ত করার জন্য অভিভাবকদের শিশুর খিঁচুনির সময় মুঠোফোনে তা ভিডিও করে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া প্রয়োজন। এতে চিকিৎসক ভিডিও দেখে রোগটি দ্রুত শনাক্ত করতে পারেন । এর বাইরে বিভিন্ন পরীক্ষা তো আছেই ।
মৃগী রোগের কিছু, আর ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তাদের রোগটি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না । তাদের আসলে ভাগ্য খারাপ। তাদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে।
শিশুর বুদ্ধির বিকাশ কমিয়ে দিতে পারে—চিকিৎসকেরা তা খেয়াল রেখেই ওষুধ দেন।
চিকিৎসায় মৃগীরোগ ভালো হয়—এ সচেতনতা গড়ে উঠলে চিকিৎসার গ্যাপ কমিয়ে আনা সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন চিকিৎসকেরা ।
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ঔষধে কোনো কাজ হয় না । তাদের জন্য অস্ত্রোপচার, ডিভাইস লাগানো সহ বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি আছে।