মাইল্ড স্ট্রোক হলে কি করবেন

মাইল্ড স্ট্রোক মস্তিষ্কজনিত একটি রোগ। একে মিনি স্ট্রোকও বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে জমাট বেঁধে এক ধরনের বাঁধার সৃষ্টি করে যার ফলে রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। চিকিৎসা শাস্ত্রে একে বলা হয় স্কিমিক অ্যাটাক বা টিআইএ।

এমন যদি হয় তাহলে যদিও মস্তিষ্ক সামান্য পরিমানে রক্ত ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু মস্তিস্কের কোষ সমূহ অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় অক্সিজেন ও শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই এই কোষ গুলো মরতে শুরু করে। আবার মস্তিস্কের ওই কোষ গুলো শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করতঃ ওই অংশ প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।

মাইল্ড স্ট্রোক করলে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, অবশ্য পরে আবার এটি চালু হয়।

দুই ধরনের মাইল্ড স্ট্রোক হতে পারে,যেমন:

(০১) হেমোরেজিক স্ট্রোক।

(০২) স্কিমিক স্ট্রোক ।

হেমোরেজিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ হতে পারে, তবে স্কিমিক স্ট্রোকে রক্ত ক্ষরণ হয় না ।

সাধারণতঃ উচ্চ রক্ত চাপ, কোলেস্টেরল, ডায়বেটিকস, ধূম পান বা যে কোন ধরনের অ্যালকোহল থেকে এই ধরণের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রতিরোধে আগে থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

চিকিৎসকরা মনে করেন, মাইল্ড স্ট্রোক থেকে বড় ধরনের স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে মাইল্ড স্ট্রোক করা রোগীর শতকরা ৫ শতাংশই পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বড় ধরনের স্ট্রোকের সম্মুখীন হয়।

স্ট্রোকের লক্ষণ ও উপসর্গ সমূহঃ

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কিংবা আঞ্চলিক ভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়া দুই অবস্থাতেই প্রায় একই ধরনের লক্ষ্মণ বা উপসর্গ দেখা যায়। স্ট্রোক হলে সাধারণতঃ যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ সমূহ দেখা যায় সে গুলো হল, মাথা ঝিম ঝিম করা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথার সাথে ঘাড়, মুখ এবং দুই চোখের মাঝখান পর্যন্ত ব্যথা হওয়া, হাঁটতে কিংবা চলাফেরা করতে এবং শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হওয়া, কথাবার্তা জড়িয়ে যাওয়া এবং অস্পষ্ট শোনানো, শরীরের এক পাশে দূর্বল, অসাড় কিংবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া, চোখে অস্পষ্ট দেখা, অন্ধকার দেখা কিংবা ডাবল ডাবল দেখা, বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া ইত্যাদি।

স্ট্রোক হওয়ার পর করণীয়ঃ

শরীরের কোনো এক দিকে দুর্বলতা বোধ করা বা শরীরের কোনো এক দিক নাড়াতে না পারা, হাত-পায়ে অবশ ভাব, মুখ এক দিকে বেঁকে যাওয়া, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হওয়া, কথা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া, বমি হওয়া, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া, মুখের অসাড়তা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, বেসামাল হাঁটা চলা, হঠাৎ খিঁচুনি বা ধপ করে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলে বুঝতে হবে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন হলে রোগীকে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। এ অবস্থায় কোনো খাবার বা ঔষধ মুখে দেয়া যাবে না। কারণ এগুলো শ্বাস নালিতে ঢুকে আরও ক্ষতি করতে পারে। বরং মুখে জমে থাকা লালা, বমি পরিষ্কার করে দিতে হবে। টাইট জামা-কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার সময় খেয়াল করে রোগীর আগের চিকিৎসার ফাইল সঙ্গে নিতে হবে।

অতি দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণতঃ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি ব্রেইনের রেডিওলজিক টেস্ট, সিটি স্ক্যান, এমআরআই করা উচিত। ঘাড়ের রক্ত নালির ডপলার, হার্টের সমস্যার জন্য ইকো পরীক্ষা করা উচিত। রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা পরীক্ষা করে নিতে হবে। প্রয়োজনে এনজিওগ্রাম ও ইকো-কার্ডিও-গ্রাফি পরীক্ষাও করতে হবে। চিকিৎসা করাতে হবে দ্রুত।

স্ট্রোক হলে আক্রান্ত এলাকার মস্তিষ্ক কোষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সহ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত সরবরাহ ২ থেকে ৫ মিনিটের বেশি বন্ধ থাকলে স্নায়ু কোষ স্থায়ীভাবে ধ্বংস হয়।

স্ট্রোকের চিকিৎসাঃ

যেহেতু স্ট্রোক ব্রেইনের রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার জন্য হয় এবং ব্রেইন কম রক্ত প্রবাহ নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না, সেহেতু স্ট্রোকের চিকিৎসা তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু করতে ঔষধ প্রয়োগ করে রক্তের চাপ, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে। রক্তের জমাট বাঁধা অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে। প্রাথমিক ধাপ কাটিয়ে ওঠার পর বহু দিন পর্যন্ত ফিজিও-থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। স্ট্রোক হয়েছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

যাদের স্ট্রোক হতে পারেঃ

স্ট্রোক সাধারণতঃ ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষদের সব চেয়ে বেশি হয়।

এছাড়াও যাদের স্ট্রোক হতে পারেঃ

উচ্চ রক্ত চাপ, বহু মূত্র বা ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, অতিরিক্ত মোটা বা স্থূলতা ইত্যাদি রোগ থাকলে।

পারিবারিক ভাবে অর্থাৎ পরিবারে কারও স্ট্রোক কিংবা হার্ট এ্যাটাক হওয়ার ইতিহাস থাকলে।

ধূমপান বা অ্যালকোহলজনিত সমস্যা থাকলে।

হৃদ পিন্ডের অসুখ যেমন- নাড়ীর অস্বাভাবিক স্পন্দন, হৃদ পিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, হৃদ পিন্ডের ত্রুটি কিংবা হৃদ পিন্ডের সংক্রমণ ইত্যাদি রোগ থাকলে।

কোন হরমোন থেরাপি অথবা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষধ সেবনের ফলে।

পূর্বে এক বা একাধিক বার স্ট্রোক অথবা টিআইএ হয়ে থাকলে।

স্ট্রোক প্রতিরোধে করনীয়ঃ

স্ট্রোক প্রতিরোধের সব চেয়ে ভাল উপায় হলো স্ট্রোকের ঝুঁকি সর্ম্পকে জানা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলা।

এই স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পদ্ধতি হলো:

নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা এবং উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না এবং কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

সঠিক নিয়মে সময়মত এবং সঠিক পরিমানে খাবার খেতে হবে।

নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম অথবা সময় করে হাঁটা বা হালকা দৌড়াতে হবে।

শরীর যেন মুটিয়ে না যায় অর্থাৎ দেহের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।

খাদ্য তালিকায় শাকসব্জী, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুটকী মাছ, দুধ, ভূষি সমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি রাখতে হবে।

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা যাবে না।

ধূম পান থেকে বিরত থাকতে হবে।

অ্যালকোহল বা নেশা জাতীয় কোন দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

স্ট্রোকের ফলে যা হতে পারেঃ

স্ট্রোকের ফলে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন- শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মাংস পেশী অবশ হয়ে যাওয়া বা প্যারালাইসিস, স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, কোন কিছু বুঝতে সমস্যা হওয়া, খাবার খাওয়ায় অথবা খাবার গিলতে সমস্যা ইত্যাদি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *