গলার রোগ গল গণ্ড

থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই গল গণ্ড বা গয়টার বলা হয়।

থাইরয়েড হলো প্রজাপতি আকৃতির একটি গ্রন্থি যা গলার গোড়ায়,

ল্যারিনক্স (পুরুষের অ্যাডামস আপেল)–এর ঠিক নিচে অবস্থিত।

থাইরয়েড থেকে থাই-রক্সিন এবং ট্রাই-আয়োডো-থাই-রোনিন নামের,

হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শরীরের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের থাইর-য়েডের ওজন ২৫ গ্রামের মতো।

এর বাম ও ডান দিকের দুই অর্ধাংশকে
থাইর-য়েডের লোব বলা হয়,

মাঝ খানের ইস্মাস দ্বারা এটি যুক্ত থাকে। যে কোনো কারণে গোটা থাইর-য়েডের বা,

এর কোনো লোবের আকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই গয়-টার বা গল-গণ্ড।

গল-গণ্ডের কারণঃ

গল-গণ্ডের উল্লেখ যোগ্য কারণ হলোঃ

আয়োডিনের ঘাটতিঃ

এক সময় সারা বিশ্বে গল গণ্ডের প্রধান কারণ ছিল আয়োডিনের ঘাটতি।

আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতি দিন অন্তত,

১৫০ মাইক্রো গ্রাম আয়োডিন খাওয়া উচিত।

তবে খাবার লবণের সঙ্গে আবশ্যক ভাবে আয়োডিন মেশানোর আইন,

বাস্ত-বায়-নের পর থেকে অন্যান্য দেশের মতো,

আমাদের দেশেও এখন আয়োডিন ঘাটতি,

আর নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে, আয়োডিনের আধিক্যও গলগণ্ড,

এবং থাইর-য়েডের অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

হাশি-মোটোস থাইরয়-ডাইটিসঃ

এটি একটি অটো-ইমিউন রোগ। এতে রোগীর নিজের থাইর-য়েড গ্রন্থির বিরুদ্ধে,

অ্যান্টি বডি তৈরি হয় এবং ফলা ফল হিসেবে থাইর-য়েড ফুলে যাওয়ার পাশা পাশি,

এর হরমোনের স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে গ্রন্থি ফোলার সঙ্গে,

হাইপো-থাইরয়ে- ডিজমের উপসর্গ দেখা দেয়।

গ্রেভ ডিজিজঃ

থাইর-য়েডের হরমোনের আধিক্য বা হাইপার-থাইরয়ে-ডিজমের

প্রধানতম কারণ গ্রেভ রোগ। এতে গ্রন্থি ফোলার সঙ্গে চোখের পরিবর্তন,

বুক ধড়-ফড়ানি, ঘাম, গরম লাগা, ওজন হ্রাস, ডায়রিয়া ইত্যাদি লক্ষণীয়।

থাইর-য়েড নডিওলঃ

এক বা একাধিক নডিওল (ক্ষুদ্র গোলাকার গুটি) থাকলে থাইর-য়েডের আকার বড় হতে পারে।

একাধিক নডিওল থাকলে গল-গণ্ডের আকার অনেক বড় হতে পারে।

থাইর-য়েড ক্যান-সারঃ

যদিও বেশির ভাগ থাইর-য়েড নডিওল নিরীহ ধরনের,

কিছু কিছু নডিওল, থাইরয়েড ক্যানসারের কারণে হয়।

থাইর-য়েডের প্রদাহের কারণেও এর আকার বড় হতে পারে।

এ ছাড়া বয়ঃ-সন্ধি-কাল এবং গর্ভাবস্থার মতো,

প্রাকৃতিক স্বাভাবিক অবস্থায়ও থাইরয়েডের আকার সামান্য বেড়ে যেতে পারে।

ঝুঁকিতে যারাঃ

খাবারে আয়ো-ডিনের অভাব, থাইর-য়েড নডিওল, ক্যান-সার বা,

অন্য কোনো থাইর-য়েড রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এবং নারীর ঝুঁকি,

পুরুষের তুলনায় বেশি। গর্ভাবস্থায় এ ঝুঁকি আরও বাড়ে।

এ ছাড়া বয়স চল্লিশের বেশি, অন্য কোনো রোগের কারণে আগে মাথা বা,

গলায় রেডিয়েশন থেরাপি পেয়েছেন এমন ব্যক্তি, হার্টের ঔষধ অ্যামিও-ডারন,

মনো-রোগের ঔষধ লিথি-য়াম এবং আরও কিছু ঔষধ সেবন থাইর-য়েড গ্রন্থির ওপর প্রভাব ফেলে।

খাবারের সঙ্গে গল গণ্ডের সম্পর্কঃ

খাবারের কিছু কিছু উপাদান থাইর-য়েড হরমোন তৈরি বাধা গ্রস্ত করে,

এবং এর ফলে গল গণ্ড হতে পারে। এদের মধ্যে কিছু কিছু সবজি যেমন বাঁধা কপি,

ফুল কপি, শাল গম, ব্রকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, কেল, কলার্ড গ্রিনস,

বোক চয় এবং সয়া-সমৃদ্ধ খাবার যেমন সয়া দুধ, সয়া সস, তোফু, টেম্প, মিসো অন্যতম।

তবে এ গুলো পুষ্টি কর খাবার এবং স্বাভাবিক পরিমাণে এমন কি,

প্রতি দিন খেলেও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া ভালো ভাবে সেদ্ধ করে খেলে,

এদের ক্ষতি কর উপাদান অনেক কমে যায়। তাই গল গণ্ড হলে এ গুলো খাওয়া,

একে বারেই বন্ধ করা বিজ্ঞান সম্মত নয়। তবে থাই-রক্সিন বড়ি খাচ্ছেন এমন রোগী,

এবং যাদের আয়োডিনের ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে,

তাদের সয়া-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণে সতর্কতা জরুরি।

করণীয় –

গল গণ্ড থাকার অর্থ এই নয় যে থাইর-য়েড গ্রন্থি খারাপ বা এটি কেটে ফেলতে হবে।

অনেকেই ক্যান-সার বা টিউ-মারের ভয় করেন। সব গল গণ্ডই খারাপ নয়।

এমনকি আকারে বড় হওয়ার পরও থাইর-য়েড,

স্বাভাবিক পরিমাণে হরমোন তৈরি করতে পারে।

তবে কারও কারও থাইর-য়েড হরমোনের মাত্রা বেশি (হাইপো-থাইরয়ে-ডিজম) বা,

কম (হাইপো-থাইরয়ে-ডিজম) হতে পারে। তাই গল গণ্ড হলে,

থাইর-য়েডের কার্য-কারিতা এবং এটি ক্যানসার কি না, এ দুটো বিষয় খুঁজে দেখা জরুরি।

উপসর্গঃ

গলার সামনে ফুলে যাওয়া, যা ঢোঁক গেলার সঙ্গে ওঠা নামা করে, এ রকম মনে হলে,

খেয়াল করুন খেতে বা শ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হয় কি না।

অনেক সময় গলা ব্যথা থাকতে পারে। গল গণ্ডের আকার বড় হলে,

শ্বাস-প্রশ্বাসে শব্দ হতে পারে বা কণ্ঠ স্বর পরিবর্তন হতে পারে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে যাওয়া,

এবং মাথা ব্যথার মতো উপ সর্গ হতে পারে।

এ ছাড়া থাইর-য়েড হরমোনের মাত্রার
তারতম্য থাকলে হাইপো-থাইরয়ে-ডিজম বা,

হাইপো-থাইরয়ে-ডিজমের উপসর্গ গুলো দেখা দিতে পারে।

গল গণ্ড মনে হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে গলা পরীক্ষা করাবেন,

এবং প্রয়োজন ও সম্ভাব্য রোগের ধরন অনুযায়ী রক্তের টিএসএইচ, ফ্রি-টিফোর,

ফ্রি-টিথ্রি হরমোন সহ অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে।

এ ছাড়া থাইরয়ে-ডের আলট্রা-সনো-গ্রাফি এবং স্ক্যান লাগতে পারে।

ক্যান সার সন্দেহ হলে ক্ষুদ্র গোলাকার পিণ্ডের,

এফএনএসি বা বায়োপসি প্রয়োজন হতে পারে।

গল গণ্ডের চিকিৎসাঃ

রোগীর লক্ষণ, গল গণ্ডের আকার এবং এর কারণের ওপর চিকিৎসার প্রয়োজন,

ও ধরন নির্ভর করে। আকারে ছোট, চোখে পড়ে না,

এমন উপসর্গহীন নিরীহ ধরনের (ক্যানসার নয় এমন),

গল-গণ্ডের সাধারণত কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না।

থাইর-য়েড হর-মোনের মাত্রা বেশি (হাইপো-থাইরয়ে-ডিজম) বা,

কম (হাইপো-থাইর-য়েডিজম) হতে পারে; সে অনুযায়ী ঔষধ দিতে পারেন চিকিৎসক।

এ ছাড়া থাইর-য়েডের প্রদাহ কমাতে ব্যথার ঔষধ, এমনকি কোনো কোনো,

জটিল অবস্থায় স্টের-য়েড সেবনের প্রয়োজন হতে পারে।

গল গণ্ডের আকার বড় হলে শুধু ঔষধে কাজ না–ও হতে পারে,

এ রকম ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন বা থাইর-য়েড সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

মনে রাখবেন, বেশির ভাগ গল গণ্ডেরই সার্জারি লাগে না,

বরং অপ্রয়ো-জনীয় থাইর-য়েডের সার্জারি পরবর্তী সময়ে নানাবিধ সমস্যার কারণ হতে পারে।

প্রয়োজনে সার্জারিঃ

অনেক বড় আকারের গল গণ্ড যা শ্বাস নালি,

খাদ্য নালি, গলার স্নায়ু বা রক্ত নালির ওপর,

চাপ প্রয়োগ করে শ্বাস কষ্ট, খাবার গিলতে অসুবিধা,

কণ্ঠ স্বর পরিবর্তন বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থাইর-য়েডের ক্যানসার ধরা পড়লে বা সন্দেহ হলে।

যদি ঔষধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দিয়ে হাই-পার-থাই-রয়েডি-জম রোগ না সারে,

অথবা ঔষধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দেওয়ার পর জটিল পার্শ্ব প্রতি ক্রিয়া হয়,

বা রোগী এ ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সার্বিক বিচারে উপযোগী না হন।

রোগী ঔষধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসায়,

রাজি না থাকলেও বিকল্প হিসেবে থাইরয়েড সার্জারি করা হয়।

ইহা যদি আপনার জীবন যাত্রার স্বাভাবিক-তাকে ব্যাহত করে,

বা আপনার সৌন্দর্য-হানির কারণ বলে মনে করেন।

তাই গল গণ্ড হয়েছে বলে মনে করলে আতঙ্কিত,

না হয়ে হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

খুব অল্প ক্ষেত্রেই গল গণ্ডের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়,

এবং সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে আরও অল্প সংখ্যক রোগীর।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *