জলাতঙ্ক সম্পর্কে যা জানা জরুরি
জলাতঙ্কঃ একে হাইড্রোফোবিয়া কিংবা পাগলা রোগও বলা হয়। আক্রান্ত রোগী পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম হয়েছে জলা তঙ্ক। এটি প্রাণি বাহিত র্যাবিস ভাইরাসঘটিত রোগ, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে এক জন এবং প্রতি বছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলা তঙ্ক রোগে মারা যান । বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন জলা তঙ্কে। শুধু মানুষই নয়, প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলা তঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশে।
রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতেই গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোলের উদ্যোগে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—জলা তঙ্ক: ভয় নয়-সত্য জানুন।
কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বাদুর, বেজি, বানর ইত্যাদি প্রাণী জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত প্রাণীটি সুস্থ মানুষ বা গবাদি পশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা গবাদিপশুও এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে এবং কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তির ৪০ শতাংশই হলো ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
আক্রান্ত প্রাণীর মুখের লালায় জলা তঙ্কের ভাইরাস থাকে। ভাইরাস বহনকারী এই লালা সুস্থ ব্যক্তির শরীরে পুরোনো ক্ষতের বা দাঁত বসিয়ে দেওয়া ক্ষতের মাধ্যমে কিংবা সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমে রক্তের সংস্পর্শে এলে বা অতি দুর্লভ ক্ষেত্রে আক্রান্ত প্রাণীর লালা থেকে সৃষ্ট অ্যারোসল বাতাসের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির ফুস ফুসে প্রবেশ করলে র্যাবিস ভাইরাস ধীরে ধীরে প্রান্তীয় স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
ফলে গলবিল এবং খাদ্য নালির মাংস পেশির কাজ নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুও আক্রান্ত হয় । সাধারণতঃ আক্রান্ত প্রাণী সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ানোর ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে এ সময় সীমা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্তও হতে পারে ।
শুধু পানির প্রতি আতঙ্কই নয়, জলা তঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণেও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায় । অস্বাভাবিক কথাবার্তা ও ভাব ভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো, ক্ষুধা মান্দ্য, খাওয়া দাওয়ায় অরুচি, বিকৃত আওয়াজ, কণ্ঠ স্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বিনা প্ররোচনায় অন্যকে আক্রমণ বা কামড় দেওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি কিছু লক্ষণ প্রকাশ করতে পারেন ।
আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেলেও পানি দেখলেই তিনি আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়েন। আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এলে এ ভীতি আরও বেড়ে যায় । এ জন্য জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্ধকারে ও মানুষের চোখের আড়ালে একাকী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ।
তবে শুধু পানিই নয়, খাবার খেতেও আক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট হয় এবং খিঁচুনি সহ মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা নিঃসৃত হয়। ক্ষেত্র বিশেষে জলা তঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষা ঘাত, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়া, ঝিমুনি হওয়া, ক্ষত স্থানে অবশতা ও অসারতা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে। শরীরের শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ও মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস কষ্ট দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত অবধারিত ভাবে মৃত্যু বরণ করেন।
টিকা গুরুত্বপূর্ণঃ
সাধারণতঃ লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগী মারা যান । কোনো অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না । কিছু উপশম প্রশমনের চিকিৎসা ছাড়া জলা তঙ্কের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই । তবে জলা তঙ্কের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা রয়েছে, যা রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে শরীরে প্রয়োগ করতে পারলে মৃত্যু এড়ানো যায়।
জলাতঙ্কের জন্য দুই ধরনের টিকা রয়েছে। ক্ষতের তীব্রতা ও আধিক্যের ওপর ভিত্তি করে কারও ক্ষেত্রে এক ধরনের, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে উভয় ধরনের টিকা প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। যত তাড়াতাড়ি জলাতঙ্কের এ টিকা গ্রহণ করা যায়, ততই মঙ্গল।
সাধারণতঃ প্রথম দিন টিকা দেওয়ার পর ৩, ৭, ১৪, ২৮ ও ৯০তম দিনে টিকার মোট ৬টি ডোজ প্রয়োগ করতে হয় । নাভির চারপাশে চামড়ার নিচে এ টিকা নেওয়া হয় । টিকার সব কটি ডোজ সময়মতো গ্রহণ করে টিকার কোর্স সম্পন্ন করা আবশ্যক।
সচরাচর ইঁদুর, খরগোশ, কাঠ বিড়ালি, গুই সাপ ইত্যাদি প্রাণী জলাতঙ্ক ছড়ায় না, তাই এ ধরনের প্রাণী কামড় দিলে জলাতঙ্কের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পশু চিকিৎসক, চিড়িয়া খানার প্রাণীদের দেখাশোনাকারী, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বস বাসরত ব্যক্তি বা উক্ত এলাকায় ভ্রমণকারী ব্যক্তি ও যাঁরা বাড়িতে কুকুর বা বিড়াল পোষেন, তাঁদের জলাতঙ্কের প্রতিরোধ মূলক টিকা দেওয়া হয় । এ ধরনের ব্যক্তিদের ০, ৭ ও ২১ বা ২৮তম দিনে টিকার তিনটি ডোজ ও প্রতি বছর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়।
প্রাণীর টিকাঃ
জলাতঙ্ক প্রতিরোধে পোষা ও অ-পোষা সব বিড়াল-কুকুরকে জলাতঙ্কের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনাও একটি কার্যকর উপায়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মৃত্যুদূত ব্যাধিকে করায়ত্ত করা সম্ভব।
প্রাণী কামড়ালে কী করবেনঃ
কোনো সন্দেহ জনক বা অচেনা প্রাণী আঁচড় বা কামড় দিলে শুরুতেই আক্রান্ত স্থানে ক্ষত ও রক্ত পাতের তীব্রতা খেয়াল করতে হবে । এ জন্য প্রথমেই ক্ষতস্থান চেপে ধরতে হবে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর টিউবওয়েল বা কলের পানি দিয়ে প্রবহমান পানির ধারার নিচে ন্যূনতম দশ মিনিট ধরে ক্ষত পরিষ্কার করতে হবে । সম্ভব হলে কোনো অ্যান্টি ব্যাকটে রিয়াল সাবানও ব্যবহার করা যেতে পারে। ইহা ভাইরাসসহ ক্ষতে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করবে।
ক্ষত পরিষ্কার হয়ে গেলে দেরি না করে ক্ষত–পরবর্তী সংক্রমণের হার কমানোর জন্য কাছের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে ক্ষতস্থান পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট দ্রবণ দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে ।
অতঃপর ক্লোরহেক্সিডিন বা পোভিডোন আয়োডিন দিয়ে ক্ষত স্থানটিকে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে । এতে অর্ধেকের বেশি জলা তঙ্কের ভাইরাস নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ক্ষতে কোনো অ্যান্টি বায়োটিক মলমের প্রলেপ প্রয়োগ করে একটি জীবাণু মুক্ত গজ কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে ফেলতে হবে। কিন্তু ক্ষত স্থানে কোনো সেলাই দেওয়া যাবে না।
প্রয়োজনীয় ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন ও পথ্যের পাশা পাশি অবশ্যই প্রতি দিন আঁচড় বা কামড়ের ক্ষত স্থান পরিষ্কার করতে হবে। কাটা স্থানে ধুলা বালি ও ময়লা যেন না লাগে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষত প্রদাহ শুকিয়ে আসা অবধি এই নিয়ম মেনে চলা উচিত।
ক্ষতস্থানে কোনো স্যালাইন, বরফ, চিনি, লবণ, ইলেকট্রিক শক ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। বাটি পড়া, পান পড়া, চিনি পড়া, মিছরি পড়া, ঝাড় ফুঁক ইত্যাদি জলাতঙ্কের হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না।
ক্ষত স্থান কখনোই অন্য কিছু দিয়ে কাটা, চোষণ করা বা ব্যান্ডেজ করা যাবে না। এ ছাড়া কোনো কবিরাজ বা ওঝার শরণাপন্ন হয়ে কোনো অবৈজ্ঞানিক কিংবা অপ চিকিৎসা গ্রহণ করে সময় ক্ষেপণ করাও অনুচিত।
সম্ভব হলে আক্রমণকারী প্রাণীর দিকে লক্ষ রাখতে হবে। আক্রমণের কিছু দিনের মাঝে প্রাণীটি মারা গেলে বাড়তি সতর্কতা অব- লম্বন করা উচিত। এ রকম হলে প্রয়োজনে বিষয়টি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে অবগত করতে হবে।