জ্যাক মা
পৃথিবীর সফল মানুষের ব্যর্থতার কাহিনীঃ
জ্যাকের ব্যর্থতার গল্পের শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় থেকেই। জ্যাকের সেই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পুরো তিন বছর লেগেছিল। হার্ভাডে ভর্তির জন্য তিনি মোট দশবার আবেদন করেন, কিন্তু দশবারই প্রত্যাখ্যাত হন। চাকরি জীবনেও ভাগ্য তাকে বরাবরই নিরাশ করে গেছে। ছোট-বড় প্রায় ত্রিশটি কোম্পানিতে আবেদন করেও কোনো চাকরি পাননি জ্যাক।
ছোটবেলা থেকেই প্রত্যাখ্যানকে সমার্থক শব্দ হিসেবে নিয়ে বড় হওয়া এই মানুষটির জীবনে সফলতার পেছনে এই ব্যাপারটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একসময় তার মন থেকে প্রত্যাখ্যানের ভয়টাই চলে গিয়েছিল।
এমনকি আলিবাবার সফলতার আগে
তিনি দুটি উদ্যোগে বেশ খারাপভাবে ব্যর্থ হন। ইংরেজিতে দক্ষতার সুবাদে তিনি একটি স্থানীয় কলেজে বছর পাঁচেক ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। তখন তাঁর বেতন ছিল মাসে ১৫ ডলার। এ সময়ে তিনি স্থানীয় কেএফসি, হোটেল এবং পুলিশে চাকরির আবেদন করেন এবং সবখানে অকৃতকার্য হন!
সবখানে পরাজিত হয়ে বেপরোয়া জ্যাক মা এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসা করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি একটি অনুবাদ প্রতিষ্ঠান চালু করেন, কিন্তু তাতে তাঁর আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতি হলো না! সংসারের খরচ চালাতে তখনো তাকে রাস্তায় মাল টানাটানির কাজে শ্রম দিতে হলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমবার গণিতে মাত্র এক নম্বর পেয়েছিলেন । তিনবার পরীক্ষা দিয়েও ভর্তির সুযোগ পাননি ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে । শেষ পর্যন্ত যেখানে ভর্তি হয়েছিলেন, সেটার তেমন কোনো নাম ছিল না। ব্যর্থতার সেই গল্প দীর্ঘ হয়েছে পরবর্তী সময়েও। কেএফসিতে কাজের জন্য আবেদন করে ২৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ২৩ জনই নিয়োগ পেয়েছিল, শুধু তিনিই পান নি। যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলেন, প্রতি ৫ জনে ৪ জন চাকরি পেয়েছিল, ভাগ্য খোলে নি সেখানেও। তবু ব্যর্থতার এমন অসংখ্য গল্প ছাপিয়ে তার সাফল্যের পাল্লাটাই ভারি হয়েছে পরবর্তীতে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ‘আলী বাবা’ হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্হানীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।
জ্যাক মা এর কথাঃ
১৯৬৪ সালে জন্ম নেওয়া জ্যাক ছোটবেলা থেকেই শেখার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। নিজের ইংরেজি বলার দক্ষতা বাড়াতে অভিনব এক কৌশল বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তরুণ জ্যাক বাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যেকদিন স্থানীয় হাংযু নামক হোটেলে আসতেন বিদেশিদের সাথে কথা বলার জন্য।
৯ বছর ধরে তিনি ৭০ মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে পর্যটকদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতেন, শুধুমাত্র ইংরেজী শেখার জন্য!
এরকমই এক পর্যটকের সাথে তাঁর এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিই মা ইউনকে ‘জ্যাক মা’ নাম দেন। কারণ তার চীনা নামটি ইংরেজদের জন্য উচ্চারণ করা নাকি কঠিন ছিলো।
আলিবাবার পথ চলা শুরু করার বছর পাঁচেক আগেও জ্যাক মা ইন্টারনেট সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম ইন্টারনেট নামক মাধ্যমের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন।
পরের বছরের প্রথম দিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ইন্টারনেটের প্রথম পাঠ নেন। পরে নিজেই এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি সাধারণ ওয়েবসাইট তৈরি করেন।
সে বছরই জ্যাক তার স্ত্রী জ্যাং ইং এর সহযোগিতায় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে প্রায় বিশ হাজার ইউএস ডলার সংগ্রহ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন বন্ধুর সহযোগিতায় ‘China Yellow Pages‘ নামের একটি কোম্পানি তৈরি করেন।
তাদের মূলতঃ কাজ ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়া, যদিও জ্যাক প্রোগ্রামিং এর কিছুই জানতেন না। মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেই কোম্পানি প্রায় আট লক্ষ ইউএস ডলারের মতো মুনাফা লাভ করে।
১৯৯৯ সালে নিজের স্থায়ী ঠিকানা হাংযুতে ফিরে আসেন জ্যাক এবং নিজের আঠারো জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাঁচ লক্ষ ইয়েন মূলধনের নতুন একটি চীন ভিত্তিক স্টার্টআপ শুরু করেন, সেটিই ‘আলিবাবা’।
আলিবাবা’র আইডিয়া যখন তার মাথায় আসল, তখন তিনি ভাবলেন- বন্ধুদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করবেন। তিনি তার ২৪ জন বন্ধুকে বাসায় ডাকলেন। সবার সাথে আলিবাবা’র আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু ২৪ জনের মধ্যে ২৩ জনই তার এই আইডিয়া হেসে উড়িয়ে দিলেন। তারা তার পাশে থাকতে রাজি হলেন না।
কেবলমাত্র একজন বন্ধু তার পাশে থাকতে রাজি হলেন। তবে তার সেই বন্ধু শর্ত দিলেন, যদি দেখা যায় তারা তেমন কোন লাভের মুখোমুখি হচ্ছেন না, তাহলে তারা এই ব্যবসা থেকে ফেরত যাবেন। আর সামনের দিকে যাবেন না।
হতাশা ব্যাপারটা খুব সহজেই মানুষকে আঁকড়ে ধরে। আমরা বিভিন্ন ব্যর্থতা, আর্থিক বা অন্য কোনো অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের ভালো লাগার কাজগুলো থেকে দূরে চলে যাই।
বড় বড় স্বপ্নে বিভোর হয়ে থেকে ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে ভুলে যাই। কয়েকবার চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দেই। আর এই জায়গাতেই জ্যাক মা সবার চেয়ে আলাদা। তার সফলতার পেছনে অনেক গুলো ব্যর্থতার গল্প আছে।
তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি, বরং শেখার এবং ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে বড় কিছু তৈরি করার দিকগুলোতে বেশ সময় দিয়েছেন।
জ্যাক মা’র জীবন থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়, তা হল তিনি লক্ষ্যের ব্যাপারে কখনোই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন না। তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, তিনি কী করতে চান, কেন করতে চান এবং কীভাবে করতে চান।
জ্যাক মা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ না হয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করা যায়। পণ্যের উপর নির্ভরশীল ব্যবসা গুলোতে তার
সফলতার মূল কারণ তার দৃষ্টি ভঙ্গি।
তিনি বারবার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর লক্ষ্য না রেখে গ্রাহকদের চাহিদার উপর লক্ষ্য রেখে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন। এমন করেই সফলতায় ছাড়িয়েছেন
সমসাময়িক সকলকে।
জ্যাক মার ব্যর্থতা:
আলিবাবার আগে জ্যাক মা সত্যি সত্যিই একজন পুরোপুরি ব্যর্থ মানুষ ছিলেন। ৪ বার ফেল করে কলেজে ঢোকার পর, যখন পাশ করে বের হলেন – তখন ব্যর্থতা কাকে বলে, তা তিনি আবারও হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। জ্যাক মার জীবন কাহিনী-এর সবচেয়ে করুণ, কিন্তু শক্তিশালী অংশ এটি।
‘হ্যাং-চাও দিয়ানজি ইউনিভার্সিটি’তে ইংরেজীর লেকচারার হিসেবে যোগ দেয়ার আগে, তিনি ৩০টি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন, এবং প্রতিটিতেই ব্যর্থ হন।
আমেরিকান একটি টক শোতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে জ্যাক মা বলেছিলেনঃ
”আমি যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলাম, ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের চাকরি হল; আমাকে বলা হল, ‘তুমি উপযুক্ত নও’। – আমার শহরে যখন কেএফসি আসলো, আমরা ২৪ জন চাকরির আবেদন করেছিলাম । ২৩ জনের চাকরি হল, আমি বাদ পড়লাম।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আমি ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। তারপর চিন্তা করলাম ‘হয়তো একদিন আমি হার্ভার্ডে লেকচার দেব।“
আরেকটি সাক্ষাৎকারে জ্যাক বলেছিলেন, “২০০৩ সালে যখন আমরা ‘তাওবাও’ শুরু করি, তখন আমার টিমের সবাইকে বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস নিয়ে আসতে। আমাদের বেশিরভাগই বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস বাসায় খুঁজে পাইনি। কারণ আমরা আর্থিক ভাবে খুবই গরিব ছিলাম।“
জ্যাক মার উক্তিঃ
আলিবাবা কিন্তু জ্যাক মার প্রথম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। এর আগে দু’টো ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। এবং একটিতেও বলার মত সাফল্য পাননি।
জ্যাক মা’র আসল নাম ‘ মা ইউন ‘। তিনি ১৫ই অক্টোবর, ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দে চীন দেশে জন্ম গ্রহণ করেন ।
জ্যাক মা একজন চীনা উদ্যোক্তা, যিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন পাইকারী ক্রয়-বিক্রয় সাইট আলিবাবা’র প্রতিষ্ঠাতা , সাবেক সিইও, ও বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০১৯ এর এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী তাঁর বর্তমান সম্পদের পরিমান ৪০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই বিপুল সম্পদ তাঁকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের একজন করেছে ।
বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্যবসা বানিজ্যকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে যে কয়জন মানুষের অবদান সব চেয়ে বেশি – জ্যাক মা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মানুষদের একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে পৃথিবীর সেরা ৫০ জন নেতার তালিকায় ২য় স্থান দেয়।
তিনি ১৯৮৮ সালে হ্যাং-চাও টিচার্স ইন্সটিটিউট (বর্তমান ‘হ্যাং-চাও নরমাল ইউনিভার্সিটি) এর ইংরেজী বিভাগ থেকে বি.এ ডিগ্রী নিয়ে বের হন।
এর পর ২০০৬ সালে বেইজিং-এর ‘চিউং-কং গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস’ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় ডিগ্রী নেন।
ইন্টারনেটের সাথে পরিচয়:
জ্যাক মা তাঁর ইংরেজী শিক্ষকের চাকরিটা বেশ উপভোগ করতেন। কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম। মাসে মাত্র ১২ ডলার! এই সামান্য বেতনে বলতে গেলে কিছুই করা যায় না।
তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র থেকে বের হয়ে আসা। এত কষ্ট করে পড়াশুনা করার পেছনেও দারিদ্র থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পড়াশুনার পর সম্মানজনক একটা চাকরি পেয়েও তাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপই রয়ে গেল।
জ্যাক মার এক সময়ে মনে হল, তিনি তো ইংরেজীর জ্ঞান কাজে লাগিয়েই একটি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ৯০ দশকের একদম শুরুর দিকে তিনি তাঁর অনুবাদ সংস্থা বা ট্রান্সলেশন ফার্ম খুলে বসলেন।
অর্থের বিনিময়ে চীনা ভাষা থেকে ইংরেজী, এবং ইংরেজী থেকে চীনা ভাষায় বিভিন্ন জিনিস অনুবাদ করতেন। মাঝে মাঝে দোভাষীর কাজও করতেন।
জ্যাক মার উক্তি-
এরকম একটি দোভাষীর কাজ নিয়েই তিনি ১৯৯৫ সালে আমেরিকা যান। এর এক বছর আগে তিনি প্রথমবার ইন্টারনেট সম্পর্কে জেনেছিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার পর প্রথম তিনি স্বচক্ষে ইন্টারনেট দেখেন, এবং বিষয়টি তাঁকে দারুন প্রভাবিত করে।
বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটির প্রতিষ্ঠাতা-মালিক ৩০ বছর বয়স পার করে ইন্টারনেটের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।
জ্যাক মা ইন্টারনেটে প্রথম যে শব্দটি লিখে সার্চ দেন, তা ছিল “বিয়ার”। বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানীর বিয়ার সার্চ এলেও চীনের কোনও কোম্পানী সেখানে ছিলো না। যদিও চীনে বেশ ভালো বিয়ার তৈরী হত।
এছাড়া, তিনি চীন সম্পর্কে আরও কিছু বিষয় সার্চ করেন, কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। বিষয়টি জ্যাক মাকে বেশ ভাবনায় ফেলে। এবং তখন থেকেই তাঁর মাথায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ব্যবসা করার চিন্তা আসে।
তিনি ইন্টারনেট সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানতেন না। এমনকি কম্পিউটারও ভালো করে চালাতে জানতেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ জিনিস একদিন পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখবে।
জ্যাক মার ব্যবসায়িক ইতিহাস ও ক্যারিয়ার:
আলিবাবার আগে প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করে চীন সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য না পেয়ে, জ্যাক সেই সময়েই তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সহায়তায় চীন সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইট খোলেন।
ওয়েবসাইটি চালু হয় সকাল ৯:৪০ এ, এবং দুপুর ১২:৩০ এর মধ্যেই চীনের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁর সাথে কথা বলার জন্য ই-মেইল করেন! জ্যাক মা সাথে সাথে বুঝে যান, ইন্টারনেট দিয়ে ব্যবসা শুরু করা যায়।
১৯৯৫ সালের এপ্রিলে জ্যাক মা, স্ত্রী ক্যাথি ঝাং, ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু ও মিলে ২০,০০০ মার্কিন ডলার যোগাড় করে তাঁদের প্রথম কোম্পানী শুরু করেন। “চায়না পেজেস” নামের এই কোম্পানী অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন চীনা প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইট তৈরী করে দিত।
জ্যাক মার জীবন কাহিনীঃ
কোম্পানীটি চালাতে জ্যাক মা তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সাহায্য নিতেন। চীনা কোম্পানীগুলোর সাথে যোগাযোগ, চুক্তি – ইত্যাদি তিনি নিজে দেখতেন।
২০১০ সালে একটি কনফারেন্সে জ্যাক মা বলেন যে, তিনি জীবনে কোনওদিন এক লাইন কোড (প্রোগ্রাম) লেখেননি। ৩৩ বছর বয়সে প্রথম তিনি নিজের জন্য একটি কম্পিউটার কিনেছিলেন।
অন্য আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “প্রথম যেদিন আমরা ওয়েবে কানেক্ট হই, সেদিন আমি আমার বন্ধুবান্ধব ও কিছু টিভি সাংবাদিককে দাওয়াত করেছিলাম। খুবই ধীরগতির একটি ডায়াল আপ কানেকশন সেট করে আমি ইন্টারনেট চালু করেছিলাম।
পেজটির অর্ধেক লোড হতেই সাড়ে ৩ ঘন্টা লেগেছিল। এই সময়টা আমরা খাওয়াদাওয়া ও আড্ডাবাজি করে কাটিয়েছিলাম। – কিন্তু আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। আমি ওদের কাছে প্রমাণ করেছিলাম যে, ইন্টারনেট বলতে সত্যিই কিছু আছে!”
চায়না পেজেস কোম্পানীটি ৩ বছর চালানোর পর তাঁদের হাতে ৮ লাখ মার্কিন ডলারের মত মূলধন দাঁড়ায়। এরপর জ্যাক মার জীবন কাহিনী নতুন এক মোড় নেয়।
আলিবাবা অধ্যায়ঃ
১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জ্যাক মা চীনের বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি আইটি কোম্পানীর প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের শহর হ্যাং-চাও এ ফিরে আসেন এবং ১৮ জন বন্ধু মিলে অনলাইন পাইকারি পন্য বেচাকেনার সাইট আলিবাবা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন।
আলিবাবা এর নামকরন এর ইতিহাস বলতে গিয়ে, জ্যাক মা বলেছিলেনঃ
“শুরু করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, ইন্টারনেট যেহেতু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচিৎ, সেইসাথে নামটি যেন সহজেই চেনা যায়।
সেই সময়ে YAHOO নামটি ছিল সেরা – আমি অনেক দিন ধরে এমন একটি নাম বের করার চেষ্টা করছিলাম । তারপর হঠাৎ মনে হল আলিবাবা নামটি ভালো হতে পারে।
সৌভাগ্যই বলতে হবে, চিন্তাটি মাথায় আসার সময়ে আমি সানফ্রান্সিস্কোর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম।
ওয়েট্রিস খাবার সার্ভ করতে এলে, আমি তাকে বললাম আলিবাবাকে চেনে কিনা।
সে বলল সে চেনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আলিবাবা কি? – সে বলল “চিচিং ফাক”! – অসাধারণ!
রাস্তায় বের হবার পর আমি প্রায় ২০ জন মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সবাই আলিবাবা, ৪০ চোর ও তাদের গুপ্তধন – সবই জানে।
আমি বুঝে গেলাম এটা আসলেই দারুন একটা নাম হতে পারে। বলতে গেলে সবাই এটা একবারে ধরতে ও মনে রাখতে পারবে, আর নামটা শুরু হয় A দিয়ে”।
১৯৯৯ এর অক্টোবর ও ২০০০ এর জানুয়ারীতে দুইবারে মোট ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট পায় আলিবাবা।
তাঁদের এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, চীন এর আভ্যন্তরীণ ই-কমার্স মার্কেটকে উন্নত করা। এবং সেই সাথে, চীন দেশের ক্ষূদ্র ও কুটির শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।
জ্যাক মা জীবন কাহিনী আলিবাবা
২০০৩ সালে জ্যাক মা আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সিস্টেমের উন্নতির জন্য eBay এর আদলে Taobao Marketplace, আলি-পে, আলি মামা, এবং Lynx প্রতিষ্ঠা করেন।
এইসব উদ্যোগ সেই সময়ে পাগলামি হিসেবে দেখা হয়েছিল। কেউ ভাবেনি যে প্রতিটি উদ্যোগেই জ্যাক মা সফল হবেন। সেই সময়ে একটি পত্রিকা তাঁকে ‘ক্রেজি জ্যাক’ বা ‘পাগল জ্যাক’ – নামে অভিহিত করেছিল।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেল, তাওবাও দারুন সফল একটি ই-কমার্স সাইট হয়ে উঠেছে। এই সাফল্যের কারণে ই-বে বিপুল অর্থের বিনিময়ে তাওবাওকে কিনে নিতে চায়, কিন্তু জ্যাক মা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, এবং এর বদলে ইয়াহুর সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ গ্রহণ করেন।
বর্তমানে তাওবাও মার্কেটপ্লেস বিশ্বের এক নম্বর ই-কমার্স ওয়েবসাইট। এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া ওয়েবসাইট গুলোর মধ্যে অষ্টম। ২০১৮ সালের এ্যালেক্সা রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৬১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সাইটটি ব্যবহার করে।
আলি পে (বর্তমান Ant Financial) পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ‘ফিনটেক’ বা ফাইনানশিয়াল টেকনোলজি কোম্পানী, যার বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! – মূলত এই আলি-পে’র আইডিয়ার কারণেই জ্যাক মাকে পাগল খেতাব দেয়া হয়েছিল।বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল এবং অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আলিবাবা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সেঞ্জ এ আইপিও ছাড়ে। এর মাধ্যমে তারা ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পায়! এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ আইপিওর ঘটনা – যা খোদ আমেরিকার কোনও কোম্পানী করে দেখাতে পারেনি।
বর্তমানে জ্যাক মা আলিবাবা গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান। আলিবাবা গ্রুপের অধীনে মোট ৯টি বড় কোম্পানী রয়েছে।
২০১৭ সালে মা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আমেরিকার বাজারে ১ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেন।
জ্যাক মা আলিবাবা ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ঘোষণা দেন, তিনি এক বছরের মধ্যে আলিবাবা থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে শিক্ষার প্রসার ও মানব সেবার কাজে মনোনিবেশ করবেন।
এর আগে তিনি আলিবাবার সিইও পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জ্যাক মার কথা অনুযায়ী, প্রতিটি সফল মানুষের ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর অর্থের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানব সেবা ও নতুনদের সফল করার কাজে মনোনিবেশ করা উচিৎ।
ব্যক্তি জীবনঃ
স্টিভ জবস এর মত জ্যাক মা-ও তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। তাঁর পরিবারের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।
ছাত্র অবস্থায় জ্যাক মার পরিচয় হয় ক্যাথি ঝাং এর সাথে। পরবর্তীতের তাঁরা বিয়ে করেন। জ্যাক মার সাফল্যের পেছনে ক্যাথির অবদান জ্যাক সব সময়েই স্বীকার করেন।
৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার জ্যাক মোটেও সুদর্শন নন। ক্যাথির সাথে তাঁর পরিচয়ের সময়ে জ্যাক ছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ। কিন্তু তারপরও ক্যাথি জ্যাকের প্রেমে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে ক্যাথি পরে বলেছেন: “এটা ঠিক যে ও সুদর্শন নয়। কিন্তু ওর মাঝে এমন কিছু ব্যাপার ছিল, বা আছে, যা আমি অন্য কোনও পুরুষের মাঝে কখনওই খুঁজে পাইনি”।
জ্যাক মা তাঁর পরিবারের ব্যাপারে কতটা গোপনীয়তা রক্ষা করেন যে ১৯৯২ সালে জন্ম নেয়া তাঁর ছেলে মা ইউয়ানকুন বা জেরি মা – ছাড়া তাঁর বাকি দুই সন্তানের নাম বহুদিন পর্যন্ত গোপন ছিল।
সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয় সন্তান (মেয়ে) মা ইউয়ানবাও এর নাম জানা গেলেও, তাঁর ৩য় সন্তানের নাম এখন পর্যন্ত অজানা!
জেরি মা ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কেলি ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছেন। এছাড়া আর তেমন কিছু তার ব্যাপারে জানা যায়নি।
তবে, জন্মের পর বেশ কিছু বছর জেরি মা পিতামাতাকে প্রায় কাছেই পাননি। জ্যাক ও ক্যাথি – দু’জনেই আলিবাবা নিয়ে মহা ব্যস্ত ছিলেন, এবং জেরিকে সপ্তাহে পাঁচদিন ডে কেয়ার সেন্টারে রাখা হত। জেরি এক সময়ে ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। তার ব্যবহারে চরম অসামাজিতা দেখা দেয়।
এরপর জ্যাক ক্যাথিকে অনুরোধ করেন আলিবাবার জেনারেল ম্যানেজারের পদ ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনায় মন দিতে। প্রথমে রাজি না হলেও, সন্তানদের কথা ভেবে ক্যাথি তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
পুরস্কার ও স্বীকৃতিঃ
সফল উদ্যোক্তা, মানবসেবী, নেতা হিসেবে ব্যবসা ও মানবতায় অবদানের জন্য জ্যাক মা তাঁর জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। যার মধ্যে প্রধান কয়েকটি এখানে দেয়া হল:
- ২০০৪ সালে চীনের জাতীয় টেলিভিশন তাঁকে বছরের সেরা ১০ অর্থনৈতিক ব্যক্তির একজন হিসেবে ঘোষণা করে। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বড় স্বীকৃতি।
- ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাঁকে একজন তরুন আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে নির্বাচন করে।
- ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ২৫ জন ব্যবসায়িক ব্যক্তির তালিকায় স্থান পান।
- ২০০৮ সালে জ্যাক মা বিশ্বের সেরা ৩০জন সিইওর একজন হিসেবে স্বীকৃতি পান।
- ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান দেয়।
- ২০০৯ সালে জ্যাক মাকে চীনের সবচেয়ে সম্মানিত ১০ জন উদ্যোক্তার একজন ঘোষণা করা হয়।
- একই বছর চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তাঁকে দশকের সেরা ব্যবসায়িক নেতার পুরস্কার প্রদান করে।
- ২০১৩ সালের নভেম্বরে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি জ্যাক মা কে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
- ২০১৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৩০তম ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
- ২০১৫ সালে এশিয়ান এ্যাওয়ার্ড কতৃপক্ষ জ্যাক মাকে বছরের সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার প্রদান করে।
- ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০ নেতার মাঝে ২য় স্থান দেয়।
- ২০১৮ এর মে মাসে প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য ইউনিভার্সিটি অব হংকং তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
জ্যাক মার জীবন কাহিনী থেকে নেয়া কিছু মজার তথ্যঃ
** ১৯৮৮ সাল থেকে জ্যাক মা ‘থাইচি’ নামক একটি মার্শাল আর্ট চর্চা করেন। বিদ্যাটি যে তিনি ভালই জানেন, তার প্রমাণ ২০১৭ সালের কুংফু সিনেমা Gong Shou Dao; জেট লি, এবং আই.পি ম্যান-খ্যাত ডনি ইয়েন এর মত বিশ্বসেরা মার্শাল আর্ট তারকাদের সাথে সমানে সমানে লড়তে দেখা যায় তাকে।
** ২০১৪ সালে আলিবাবার বার্ষিক র্যালীতে কিম্ভূতকিমাকার সাজ নিয়ে জ্যাক মা ২০ হাজার কর্মীর সামনে ‘লায়ন কিং’ গানটির অংশ বিশেষ পারফর্ম করেন।
ডেইলি মেইল তাঁকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভট বিলিওনেয়ার’ এর খেতাব দেয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে নিজের কর্মীদের সামনে তিনি মাইকেল জ্যাকসন সেজে স্টেজে উঠে নাচ গান করেন। এমনিতেই তো আর ‘ক্রেজি জ্যাক’ নাম হয় না।
** নিজের কোম্পানীর কর্মীদের জন্মদিন, বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজির থাকেন জ্যাক মা। কর্মীদের পাশে থাকার এই শিক্ষা তিনি ‘দি গডফাদার’ থেকে পেয়েছেন!
** জ্যাক মার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা একটি কাল্পনিক চরিত্র, ফরেস্ট গাম্প। টম হ্যাংকস অভিনীত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ফরেস্ট গাম্প এর মূল চরিত্র ফরেস্ট কে তিনি বার বার ব্যর্থ হয়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন।
** বিল ক্লিন্টন একটি টক শোতে চীনের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে জ্যাক মা তাঁর মুখের ওপর বলেন, “আপনাদের এত না ভাবলেও চলবে।
আমেরিকানরা খরচ করতে পছন্দ করে বলে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা চোখে দেখা যায়। আমরা চীনারা খরচ দেখানোর বদলে টাকা জমাতে পছন্দ করি”।
“জ্যাক মা – একটি ইতিহাস আর অনুপ্রেরণা”:
বর্তমান বিশ্বে তরুন উদ্যোক্তাদের সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম জ্যাক মা। তাঁর মত, বা তাঁর চেয়ে বড় সাফল্য হয়তো অনেকেই পেয়েছেন, কিন্তু চরম দরিদ্র অবস্থা থেকে শুধুমাত্র নিজের মনোবল আর আত্ম- বিশ্বাসকে পুঁজি করে, শত প্রতিকুলতার মাঝে উঠে আসার ক্ষেত্রে জ্যাক মা অনন্য।
আজকের পৃথিবীর কোটি কোটি তরুণের আইডল, ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ জ্যাক মা। হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও যিনি নিজের শেকড় ভুলে যাননি। চালচলন, কথাবার্তায় আজও তিনি সেই “মা-ইউন”।
এত সাফল্যের পরও যাঁর পা মাটিতেই আছে। হাজার হাজার কর্মীকে উৎসাহ আর আনন্দ দিতে যিনি রীতিমত সঙ সেজে মঞ্চে পারফর্ম করেন।
নিজের দেশ আর তরুণদের উন্নয়নের জন্য নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় পদ থেকে ইস্তফা দিতেও যাঁর বাধে না।
তাঁর জীবনী আমাদের শিক্ষা দেয়, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, যত ব্যর্থতাই আসুক, মানুষ যদি নিজের বড় হওয়ার লক্ষ্যে অটল থাকে – তবে কিছুই অসম্ভব নয়।
হার্ভার্ডে ১০ বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে জ্যাক মা নিজেকে বলেছিলেন: “পড়তে হয়তো পারলাম না, কিন্তু আমি একদিন ওখানে লেকচার দেব”
এখানেই জ্যাক মার মত মানুষের সাথে সাধারন মানুষের পার্থক্য। একারণেই তিনি একজন মানুষ হয়েও, একটি ইতিহাস হতে পেরেছেন।
স্বপ্ন দেখে ব্যর্থ হলে অন্যরা যখন স্বপ্ন দেখার সাহসই হারিয়ে ফেলে, জ্যাক মা এর মত মানুষেরা আরও বড় স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন দেখে যেতে পারা, ও ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়াই জ্যাক মার মত মানুষদের সাফল্যের গোপন সূত্র।
আমরা আশা করি জ্যাক মার জীবন কাহিনী আপনাকেও অনুপ্রাণিত করবে। তাহলেই আমাদের এত গবেষণা আর কষ্ট সার্থক হবে।
বিশ্ববাজারে চীনের বাণিজ্যদূত তিনি। ফোর্বস পত্রিকার বিচারে পৃথিবীর ৫০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মধ্যে ২১তম স্থানে তাঁর অবস্থান। স্টার্টআপ বিজনেসের ক্ষেত্রে তাঁকে রোল মডেল বলে ধরা হয়।
ধনকুবের শিল্পপতির পাশাপাশি তিনি একজন বিনিয়োগকারী, সমাজসেবী এবং উদ্যোগী। একইসঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক অর্থনীতির তীব্র সমালোচক।
শূন্য থেকে শুরু করে তিনি হয়ে উঠলেন ফরচুন পত্রিকার বিচারে বিশ্বের ৫০ জন সেরা নেতার মধ্যে অন্যতম।
চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের হাংঝৌতে তাঁর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। জন্মের পরে তাঁর নামকরণ হয়েছিল’ মা ইউন ‘।
এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত হন জ্যাক মা। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আলিবাবা’র বোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান মা। গত বছর এপ্রিলে রিলায়্যান্স-ফেসবুক চুক্তি হতেই এশিয়ার ধনীতম ব্যবসায়ীর তকমা মা’এর কাছ থেকে চলে আসে অম্বানীর কাছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জ্যাক মা রিলায়্যান্সের ৯.৯৯ শতাংশ শেয়ার ফেসবুক কিনে নেয়।
বর্তমান বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকা করলে একদম প্রথমের দিকে একটি নাম চলে আসবে সেটি হল, জ্যাক মা। বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান এই মানুষটি বর্তমানে চীনের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি।
তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় পঁচিশ বিলিয়ন ডলার। অথচ মানুষটার জীবনের শুরুটা ছিল অন্য দশজন সাদা মাটা মানুষের মতন।
চীনের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নেওয়া জ্যাক মা ছাত্রজীবনে কখনোই ভালো ছাত্র ছিলেন না। জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়া এই মানুষটির জীবন থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই।
প্রত্যাখ্যান?
সে তো সফলতার আরেক নাম
কোন কাজ শুরু করার আগে দু’টি ব্যাপার আমাদের মাথায় আসে।
১. যদি কাজটি সুন্দরভাবে শেষ করতে পারি, তাহলে কী হবে?
২. যদি কাজটি কোন কারণে করতে না পারি, তাহলে কী হবে?
অবাক করা বিষয় হলো, প্রথমটির চেয়েও দ্বিতীয় ব্যাপারটাই আমাদের মাথায় সবচেয়ে বেশি আসে। এতে কিন্তু আমাদের দোষের কিছু নেই।
ছোটবেলা থেকে আমরা দেখে এসেছি, কোনো কাজে অসফল হওয়া কিংবা প্রত্যাখ্যাত হওয়া যেন ব্যর্থতারই অন্য রূপ। জ্যাক মা তার জীবনে ব্যর্থতার এই রূপের সম্মুখীন হয়েছিলেন অসংখ্যবার।
আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে এমন অনেক মানুষের সাথে আমাদের দেখা মেলে, যাদের কাছ থেকে যে কোন কাজে ‘না’ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না।
এমনকি মহৎ কোনো সামাজিক কাজেও তারা প্রথমেই ‘না’ বলে বসেন। এই ‘না’য়ের পেছনে তাদের অজুহাতেরও সীমা থাকে না।
কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে? অবশ্যই না। বরং এই ‘না’ বলা মানুষগুলোকে বাদ দিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের ইচ্ছাশক্তিকে জিইয়ে রাখা
জ্যাক মা’র জীবনের একটি শক্তিশালী দিক হল তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। আলিবাবা’র কথা বাদ দিলে তার জীবন অনেকখানি ব্যর্থ।
এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার আগে জ্যাক মা আরো দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। কিন্তু এদের কোনোটিই তখন সফলতার মুখ দেখেনি। তা-ই বলে তিনি কিন্তু বসে থাকেননি।
কঠোর পরিশ্রম এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তিনি নতুন উদ্যমে, নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন।
জ্যাক মা’র আছে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ, যাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইচ্ছাশক্তি’। এই আশ্চর্য ইচ্ছাশক্তির ফলাফল আজকের দিনের ‘আলিবাবা’।
লক্ষ্য যখন সুনির্দিষ্ট, সাফল্য তখন সুনিশ্চিত
“প্রতিটি কোম্পানিই জানে, তারা কী করছে; অনেক কোম্পানি জানে, তারা কীভাবে তা করছে; কিন্তু খুব কম কোম্পানিই জানে- তারা কেন তা করছে!”
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটি না রাখার পরেও দিন শেষে আমরা কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছি।
এর কারণ হল, কোনো কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে অন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া কিংবা তা থেকে দূরে সরে যাওয়া। প্রতিটি লক্ষ্যের পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট পথ থাকে। একজন মানুষ যখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, তখন তাকে সেই পথগুলো পাড়ি দিতে হয়।
কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা ভুল পথে হারিয়ে গিয়েছি। অর্থাৎ, প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের যে লক্ষ্য ছিল, আমরা তা থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছি।
জ্যাক মা’র জীবন থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়, তা হল তিনি লক্ষ্যের ব্যাপারে কখনোই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন না। তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, তিনি কী করতে চান, কেন করতে চান এবং কীভাবে করতে চান। জ্যাক মা’র কথা অনুযায়ী,
নিজেই যখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী
ক্র্যাব মেন্টালিটি বা কাঁকড়ার মানসিকতা বলে একটি ব্যাপার প্রচলিত আছে।
পুকুর বা নদী থেকে কাঁকড়া তুলে যখন কোনো পাত্র কিংবা জারে রাখা হয়, তখন কাঁকড়াগুলো সেই জার বা পাত্র থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে।
সমস্যার শুরু হয় এখানেই! এক কাঁকড়া যখন দেখে তাদেরই এক কাঁকড়া জার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন সে এসে তাকে শুঁড় দিয়ে টেনে ধরে। ফলে সেই কাঁকড়ার আর বেরিয়ে আসা হয় না।
অনেক সময় দেখা যায়, অন্য কাঁকড়ারাও চলে এসেছে সেই কাঁকড়াকে টেনে নামানোর জন্য। এভাবে কোনো কাঁকড়াই জার থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না।
আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের আশেপাশের মানুষ এবং পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। আমরা মানুষেরা স্বভাবগতভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পছন্দ করি।
তবে মাঝে মাঝে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিকট এবং কুৎসিত আকার ধারণ করে। তখন আমাদের অবস্থাও সেই কাঁকড়ার মতন হয়ে যায়।
জ্যাক মা’র জীবনের একটি বড় শিক্ষা হলো- তিনি তার আশেপাশের এমনকি ব্যবসা ক্ষেত্রে তার প্রতিযোগীদেরও কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না। বরং তিনি নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে পছন্দ করেন।
তিনি নিজে ঠিক করে নেন, তার আজকের দিনটি হবে গতদিনের তুলনায় আরেকটু ভালো। আপনি নিজেই যখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন আশেপাশের কোনোকিছু আপনাকে আপনার লক্ষ্য অর্জন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
জ্যাক মা’র জীবনের এই শিক্ষাগুলো যদি আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগাতে পারেন, তবে আপনার জীবনও দেখা পেতে পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের ছোঁয়ার। তবে আর দেরি কেন? আজকে থেকেই শুরু হোক এই শিক্ষাগুলোর বাস্তবায়ন!
তাঁর কোর্সের অন্যতম বিষয় ছিল ইংরেজি। মা-এর দাবি, তিনি ১০ বার চেষ্টা করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে ফিরিয়ে দেয় এই নামী প্রতিষ্ঠান।
পরে তিনি হাংঝৌ ডিয়ানঝি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বিশ্ববাণিজ্য বিষয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। প্রত্যাখ্যানের ব্যর্থতা সহ্য করতে হয়েছে এর পরেও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, অন্তত ৩০ বার চাকরির চেষ্টায় তাঁর মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আলিবাবা কর্ণধার জ্যাক মা’র মোট সম্পত্তির পরিমাণ বর্তমানে পাঁচ হাজার ৪০৮ কোটি ডলার। বিশ্বের প্রথম ৫০০ জন ধনকুবেরের মধ্যে তাঁর স্থান এই সংস্থার বিচারে ২২ নম্বরে।
ফোর্বস পত্রিকার বিচারে বিশ্বের ২০তম ধনকুবের হলেন জ্যাক মা। চীনের নিরিখে তিনি এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ধনকুবের। তাঁকে ছাপিয়ে চীনের ধনীতম হলেন ‘টেনসেন্ট’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার মা হুয়াতেং।