প্লেগ রোগের উপসর্গ কিভাবে সৃষ্টি হয় ? সেপ্টি সিমিক প্লেগ (septicaemic plague) কাকে বলে

প্লেগ (Plague) Yersinia pestis নামক ঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয় তাই ব্যাপক প্রাণ সংহারকারী বা অনিস্টকর কোন পরিস্তিতি বর্ণনায় ‘প্লেগ’ শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্লেগ অতি প্রাচীনকালীন এক ব্যাধি, প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ইতিহাস সূত্রে জানা যায় মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংসাত্মক পরিণতির শিকার হয়েছে।

Y. pestis একটি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটে- রিয়া যা ইঁদুরের ফ্লি Xenopsylla নামক পতঙ্গের অন্ত্রে বাস করে। ফ্লি ইঁদুর ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর বহিঃ পরজীবী এবং পোষকের ত্বকে দংশনের মাধ্যমে এর অন্ত্র থেকে ব্যাকটেরিয়াকে পোষকের দেহে চালান করে। কাজেই, ফ্লি ইঁদুর থেকে ইঁদুরে, কখনও কখনও ইঁদুর থেকে মানুষে প্লেগ জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে।

এক জন নিউমোনিক প্লেগে সংক্রমিত মানুষ অন্য মানুষে রোগ ছড়ায় এবং এভাবে প্লেগ মহামারীর আকার পায়। অনুমান করা হয় যে, চর্তুদশ শতকে ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ জন সংখ্যা অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,০০০,০০০ মানুষ প্লেগে আকান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এর পর বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় যে, চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় মহামারীর সূত্রপাত হয় মধ্য এশিয়ায়, যা পরে ইউরোপ, ভারত এবং চীনে বিস্তৃতি লাভ করে।

১৬৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত The Great Plague of London কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমগ্র ইউরোপে এ রোগ মাঝে মধ্যেই দেখা দিয়েছে পনেরো, ষোল এবং সতেরো শতকে।

এক সময় অনেকেই বিশ্বাস করত যে সিন্ধু নদীর পূর্বাঞ্চলে প্লেগ কখনও দেখা দেয় না। কিন্তু উনিশ শতকে ভারতের একাধিক জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রায় তিন বছর প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের পর ১৮১৫ সালে গুজরাট, কাথিওয়ার এবং কুচ এলাকায় প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়।

পরের বছরের শুরুতেই ঐ এলাকা গুলিতে এ রোগ আবার আঘাত হানে এবং ক্রমে তা সিন্ধু প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদ সহ দক্ষিণ-পূর্বে আহমাদাবাদ ও ধলেরা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে । পরে এসব এলাকা থেকে ১৮২০ সালে অথবা ১৮২১ সালের প্রথম ভাগে এ রোগ তিরোহিত হয় এবং ১৮৩৬ সালের জুলাই পর্যন্ত আর দেখা যায় নি । ১৮৩৬ সালের শেষ ভাগে রাজ পুতনার পালি শহরে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়।

ক্রমে পালি থেকে আজমীর-মারওয়া-রাতে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে । পরে ১৮৩৭ সালের গ্রীষ্ম কালে ঐ এলাকা থেকে প্লেগ স্বতঃ স্ফূর্তভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । ১৮৪৯, ১৮৫০ এবং ১৮৫২ সালে এ রোগ আবার মারাত্মক ভাবে দেখা দেয় এবং দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে । ১৮৭৬-৭৭ সালের প্রাদুর্ভাব এমন মারাত্মকভাবে দেখা দেয় যে, ভারতীয়রা এ রোগকে মাহামারী (maha murree or mahamari) নামে আখ্যায়িত করে।

দক্ষিণ চীনের বন্দর গুলিকে অনেকেই প্লেগ বিস্তারের কেন্দ্র বিন্দু বলে মনে করেন। ১৮৯৪ এবং ১৯২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রোগ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে । এ সময়ের কোন কোন মহামারী পূর্ব গুলির তুলনায় অনেক ব্যাপক ও মারাত্মক ছিল। ভারতের অনেক স্থানের মধ্যে ১৮৯৬ সালে মুম্বাই-এ এবং ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অনেক দেশের তুলনায় ভারতে প্রাণ হানি হয় বেশি ।

এক তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৯৬ এবং ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৩,১৫,৮৯২ জন, অর্থাৎ জন সংখ্যার প্রতি হাজারে ৫.১৬ জন। সৌভাগ্য বশতঃ এর পরের ২৫ বছর তেমন মৃত্যু ঘটেনি। ১৯২৩ সালে মৃত্যু সংখ্যা ছিল ২৫০,০০০; ১৯৪২-এ ১০,৫৭৭; ১৯৪৭-এ ৪১,৭৪৫; ১৯৪৮-এ ৯,৭৫৭ এবং ১৯৫২-তে ১,০০৭ জন। একটি অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে জানা যায় বার্মায় (মায়ানমার) ১৯৫৪ সালে মারা যায় ১৫৭ জন এবং ভারতে ৫৪৭ জন।

প্লেগ আক্রান্ত মানুষের যে বৈশিষ্ট্য পূর্ণ উপসর্গ প্রকাশ পায় সেটি হলো লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘বুবো’ (bubo) বা গ্রন্থি স্ফীতি। লসিকা গ্রন্থির তীব্র প্রদাহের সঙ্গে জ্বর ও ব্যথা থাকে। এই অবস্থায় ইহা বুবোনিক প্লেগ (bubonic plague) হিসেবে পরিচিত হয়। রোগের আক্রমণ মৃদু হলে সংক্রমণ প্রক্রিয়া আপেক্ষিক ভাবে লসিকা গ্রন্থির মধ্যে সীমিত থাকে, কিন্তু কিছু রোগীতে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে নিউমোনিয়ার সঞ্চার হয়।

রোগের এই ধরনের অবস্থাকে নিউমোনিক প্লেগ (pneumonic plague) নামে বর্ণনা করা হয়। এ অবস্থা রোগের দ্রুত বিস্তারে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে । কারণ, আক্রান্ত রোগী বাইরে যে কফ ফেলে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া সুস্থ মানুষের নাসিকা পথে সহজে ঢুকে পড়ে ও দেহে সংক্রমণ ঘটায় ।

অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের সাহায্যে নিউমোনিক প্লেগের চিকিৎসা না হলে তা মারাত্মক আকার নিতে পারে। মাঝে মাঝে রোগীর রক্তেও এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমিত রক্ত দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মুক্ত ভাবে চলাচল করে যে প্লেগ রোগের উদ্ভব ঘটায় তাকে সেপ্টি সিমিক প্লেগ (septicaemic plague) বলা হয়।

এতে রোগীর শ্বসন নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দেহের বর্ণ কালচে লাল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়। এ জন্যে প্লেগের আরেক নাম ‘ব্ল্যাক ডেথ ‘ (black death)।
সম্প্রতিকালে বাংলাদেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কোন রেকর্ড নেই । ১৯৯৪ সালে ভারতে দু’বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার বিস্তার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল ব্যাকটে- রিয়ার বাহক ফ্লি উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইঁদুর মেরে এবং প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ ও অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে।

সে সময় বাংলাদেশেও পূর্ব সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এ সবের মধ্যে ছিল সচেতনতা মূলক কর্মসূচি এবং সন্দেহ জনক ক্ষেত্রে তা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের দৃষ্টিগোচরে আনা ইত্যাদি । সে সময় বাংলাদেশে প্লেগে আক্রান্ত কোন রোগী শনাক্ত করা যায় নি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *