লিভার প্রতিস্থাপনে কী কী সমস্যা দেখা যায়

লিভার প্রতিস্থাপন করার পর সব চেয়ে বড় যে দুটো সমস্যা দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হল শরীরের দ্বারা নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান এবং লিভারের সংক্রমণ।

লিভারকে প্রত্যাখ্যান করা মানে কি?

একজন ব্যক্তি (দাতা)-র থেকে লিভার নিয়ে অপর ব্যক্তি (গ্রহীতা)-র শরীরে প্রতিস্থাপন করলেই গ্রহীতার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন প্রত্যঙ্গটাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক যেমন এই ক্ষমতা শরীরের বাইরের কোনও উপাদানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে সেই রকম। এর পর একের পর এক এমন কিছু ব্যাপার ঘটতে থাকে যে, প্রতিস্থাপিত প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটাকেই বলে প্রত্যাখ্যান। এটা খুব দ্রুত হতে পারে (তীব্র প্রত্যাখ্যান). বা দীর্ঘ সময় ধরেও হতে পারে (ক্রনিক প্রত্যাখ্যান)।
দাতার প্রত্যঙ্গের সঙ্গে গ্রহীতার শরীরের অবস্থা খুব ভাল করে মিলে যাওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যানের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনার শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা, মানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কাজই হল শরীরে বাইরের কোনও জিনিস ঢুকলে তাকে নষ্ট করে দেওয়া। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা অবশ্য প্রতিস্থাপিত লিভার ও অযাচিত আক্রমণ- কারী, যেমন ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারে না। সেই জন্যই প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন লিভারের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। একেই বলে প্রত্যাখ্যান পর্ব। লিভার প্রতিস্থাপন করানো প্রায় 70 শতাংশ রুগিরই শরীরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে কিছু না-কিছু পরিমাণে এই প্রত্যাখ্যান পর্ব চলে। প্রতিরোধ ক্ষমতার এই হামলা থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যাখ্যান-
বিরোধী ঔষধ পত্র দেওয়া হয়।

প্রত্যাখ্যানকে কী ভাবে রোধ করা যায়?

লিভার প্রতিস্থাপনের পর ইমিউনোসা- প্রেস্যান্টস নামক ঔষধ দেওয়া হবে। প্রতিরোধ ক্ষমতার নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেবে এই ইমিউনোসাপ্রেস্যান্টস। নতুন লিভারকে প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে বাধা দিতে না-পারে, তার জন্য এই ঔষধ গুলো প্রতিরোধ ক্ষমতার গতিকে কমিয়ে দেয় বা একে দমিয়ে রাখে। ইমিউনোসাপ্রেস্যান্টস ঔষধগুলো খুব ভাল ভাবেই প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকিকে কমিয়ে দেয়, নতুন প্রত্যঙ্গকে রক্ষা করে এর ক্রিয়া কলাপকে সুরক্ষিত রাখে। এই ঔষধ গুলো গ্রহীতার প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আটকে দেয় যাতে এই ক্ষমতার প্রতিস্থাপিত প্রত্যঙ্গের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমে যায়। এই কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কমানোর ব্যাপারে এ গুলোর সবারই কাজ করার ধরন আলাদা আলাদা। বিভিন্ন ধরনের ঔষধের মধ্যে থাকতে পারে স্টেরয়েড, সাইক্লোস্পোরিন, ট্যাক্রোলিমাস, সিরোলিমাস আর মাইকো- ফেনোলেট মোফেটিল। যেভাবে বলা হবে ঠিক সেভাবেই এই ঔষধ খেয়ে যেতে হবে সারা জীবন।

ইমিউনোসাপ্রেস্যান্টস-এর কী কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে?

ইমিউনোসাপ্রেস্যান্টস ঔষধ গুলো একজন ব্যক্তির সংক্রমণের বিরুদ্ধে থাকা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, তাই তাঁর শরীরে কোনও সংক্রমণ হলে তার চিকিৎসা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। লিভারকে প্রত্যাখ্যান করার দিক টাকে বাধা দেওয়াই এই ঔষধ গুলোর কাজ হলেও, এ গুলো কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও ফাংগাসের বিরুদ্ধে শরীরের লড়াই ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। রুগিদের উপর যেসব জীবাণু বেশি আক্রমণ চালায় সেগুলোকেই নষ্ট করে এই প্রতিরোধ মূলক ঔষধ গুলো। অবশ্য, সংক্রমণ থাকা লোকের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলাই ভাল।

প্রতিস্থাপিত লিভার গ্রহীতাদের কি সারা জীবন ধরে এইসব ঔষধ খেয়ে যেতে হবে?

সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, হ্যাঁ খেতে হবে। অবশ্য প্রতিস্থাপিত লিভারের সঙ্গে শরীর নিজেকে মানিয়ে নিলেই প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঔষধ খাওয়াটাকে ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এমন কয়েকজন রুগি আছেন যাঁরা এই সব ঔষধ খাওয়া বন্ধ করেও ভাল মতোই আছেন। গবেষকরা তাই পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করছেন যে এটা কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে।

প্রত্যাখ্যানের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো কী?

প্রতিস্থাপিত লিভারকে প্রত্যাখ্যান করার লক্ষণ ও উপসর্গের তালিকা নীচে দেওয়া হল:

100 ডিগ্রির উপরের জ্বর

অবসান ও অতিরিক্ত ঘুম পাওয়া

খামখেয়ালি ভাব

মাথা ব্যথা

পেট ফোলা, নরম হওয়া বা ব্যথা

অরুচি বেড়ে যাওয়া

জন্ডিস (ত্বক ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া)।

ঘন (খয়েরি) রঙের প্রস্রাব

চুলকানি

বমি বমি ভাব

এগুলো কোনওটাই প্রত্যাখ্যানের নির্দিষ্ট উপসর্গ নয়। কিন্তু এগুলোর প্রতি নজর দেওয়া একান্তই দরকার। তাই এসব দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখাতে হবে। তিনিই বিচার বিবেচনা করে দেখবেন যে, এগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখার কোনও প্রয়োজন আছে কি না। বা কিছু সময় অপেক্ষা করে নিলে ভাল হয়।
প্রত্যাখ্যানের আসলে কোনও উপসর্গই দেখা যায় না বলে সব চেয়ে ভাল উপায় হল প্রতিস্থাপনের পর নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো। সেটা করালেই প্রতিস্থাপিত লিভারকে প্রত্যাখ্যান করার ইঙ্গিত আগে ভাগে পাওয়া যেতে পারে। ডাক্তার লিভারের পাচক রসকে বোঝার জন্য রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন। পাচক রস থেকেই আগে ভাগে জানা যায় যে, প্রতিস্থাপিত লিভারকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে কি না। শুরুতে এই পরীক্ষাগুলো রোজই করানো হবে। লিভার প্রতিস্থাপনের পর প্রথম মাসে এই পরীক্ষা- গুলো অন্তত প্রতি সপ্তাহে করানো হবে। আস্তে আস্তে যত মাস ও বছর কাটতে থাকবে ততই প্রত্যেক বার পরীক্ষা করানোর মধ্যকার ব্যবধান বাড়তে থাকবে। প্রত্যাখ্যানের সন্দেহ দেখা দিলেই লিভার বায়োপ্সি করিয়ে সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বায়োপ্সি করার দরকারই পড়ে না, কেননা প্রত্যাখ্যানের সন্দেহ খুব দৃঢ় হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার বায়োপ্সি করাটা খুবই দরকার। বায়োপ্সির জন্য ডাক্তার লিভারের ছোট্ট একটা টুকরো নিয়ে সেটাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *