মাংকি পক্স: অগ্রাহ্য করার মত একটি রোগ

আপনি যদি এখনো করোনাভাইরাস মহা- মারির চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকেন, আপনার জন্য দুঃখিত, কিন্তু আরো একটি ভাইরাসও জেঁকে বসবার উপক্রম করছে।
এবারেরটির নাম মাংকি পক্স এবং এরই মধ্যে পৃথিবীর ১২টি দেশে ৮০ জনের দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়েছে । যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপিয়ান দেশ, যুক্ত রাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।

ঠিক কি ঘটছে? এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কি সময় এসেছে?

অনেক দেশ করোনা ভাইরাস মহামারির সময় আরোপ করা নানা ধরনের বিধি নিষেধ শিথিল করতে শুরু করেছে । মানুষ জনের মধ্যেও যেন এক ধরনের স্বস্তির ছাপ পড়তে শুরু করেছে।

এটা পরিষ্কার যে মাংকি পক্স কোভিডের মতো নয় এবং খুব শীঘ্রই এর কারণে লক ডাউন ঘোষণা হতে পারে বিষয়টা এমন না হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এর আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক।

এত দিন পর্যন্ত মাংকি পক্সের আচরণ অনুমান করা সহজ ছিল। নাম শুনে বানরের কথা মনে হলেও আসছে মাংকি পক্স ভাইরাসটি পাওয়া যায় ইঁদুরের শরীরে। ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাসভূমি পশ্চিম আফ্রিকা এবং রেইন ফরেস্টে বাস করে এমন কেউ হয়ত আক্রান্ত ইঁদুরের সংক্রমণে এলে অসুখটি ছড়ায়।

আক্রান্তদের ত্বকে বসন্তের মতো দেখা দেয়। ফোস্কার মতো তৈরি হয়ে ফেটে যায় এবং চামড়া উঠতে থাকে। কিন্তু মাংকি পক্স এখন যে সব দেশে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ইহা থাকার কথা নয় । এর প্রাদুর্ভাব এখনো স্বল্প পরিসরেই রয়েছে। ভাইরাসটি খুব অল্পতেই সংক্রমিত করতে পারছে না। দীর্ঘক্ষণের সংস্পর্শ দরকার হচ্ছে।

বিশ্বে এর আগে অল্প কিছু সংক্রমণ পাওয়া গেছে তবে যাদের শরীরে ইহা পাওয়া গেছে তারা সবাই ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাস ভূমি যেসব দেশে সেখানে ভ্রমণে গিয়ে- ছিলেন।

কিন্তু এবার যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তাতে প্রথম বারের মতো এমন সব মানুষের দেহে ইহা পাওয়া গেছে যাদের সাথে পশ্চিম অথবা মধ্য আফ্রিকার কোন যোগাযোগও নেই । ফলে কিভাবে তারা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি এখনো পরিষ্কার নয় । এর আগে যুক্ত রাজ্যসহ বিশ্বের কিছু জায়গায় এর সংক্রমণ পাওয়া গেছে। যাদের সবার সাথে প্রাকৃতিক আবাস ভূমিতে ভ্রমণের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এবার বিষয়টি তেমন নয় । গুটি বসন্তের শেষ মহামারির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ আর জল বসন্তের পার্থক্য যেভাবে বুঝবেন প্রথম বারের মতো আক্রান্ত এমন ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে যাদের সাথে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রি- কার সাথে কোন যোগাযোগ নেই।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিজ্ঞান বিষয় ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক স্যার পিটার হরবি বলছেন, “আমরা খুব নতুন এক ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি । যা খুব বিস্ময় এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।”
তিনি বলছেন, আমরা দ্বিতীয় এক কোভিড মহামারিতে পড়তে যাচ্ছি ব্যাপারটা এমন না। তবে ভাইরাসটি জেঁকে বসার আগেই দ্রুত পদক্ষেপ নেবার কথা বলছেন তিনি।

ইহা এমন কিছু যা আমাদের এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ, বলছেন স্যার হরবি। মাংকি পক্স আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. হিউ অ্যাডলার। তিনি বলছেন, “এর যে আচরণ আমরা এখন দেখছি তা আগে দেখা যায়নি। যা আশ্চর্য হওয়ার মতো।”

তাহলে কি হচ্ছে?

এখনো পর্যন্ত এটুকু জানা যাচ্ছে যে, এই প্রাদুর্ভাব ব্যতিক্রমী কিন্তু কেন সেটি জানা যাচ্ছে না।

দুটো বিকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে।
হতে পারে ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়েছে।
অথবা ভাইরাসটি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে উৎকৃষ্ট পরিবেশ পেয়েছে।

দুই হাজার আঠারো ও ২০১৯ সালে যে কয়েকটি সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল তার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। যদিও নিশ্চিত করে কিছুই এত তাড়াতাড়ি বলা যাচ্ছে না।
তবে এখনো পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে ভাইরাসটি ধরন পরিবর্তন করেছে। তবে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাবের জন্য সব সময় ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন হতে হবে এমন নয়। যেমনটা দেখা গেছে ইবোলা এবং জিকা ভাইরাসের সংক্রমণে।

লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের অধ্যাপক অ্যাডাম কুচারস্কি বলছেন, “আমাদের সব সময় ধারনা ছিল ইবোলা খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেটা কিন্তু হয়নি।” সম কামী ও উভ কামী কম বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে মাংকি পক্স কেন বেশি পাওয়া যাচ্ছে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

তবে প্রশ্ন উঠছে যৌন আচরণের কারণে কি এটি দ্রুত ছড়ায়? নাকি এটি কাকতালীয় ব্যাপার?

এমন হতে পারে যে মাংকি পক্সের জন্য ছড়ানো এখন সহজ হচ্ছে কারণ গুটি বসন্ত রোধে যে গণটিকা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে পুরনো প্রজন্মের বসন্ত কিছুটা সুরক্ষা পাবে।
পুরনো প্রজন্মের বসন্তের সাথে মাংকি পক্সের সাদৃশ্য রয়েছে।”গুটি বসন্তের যুগের চেয়ে ইহা সম্ভবত দ্রুত ছড়াচ্ছে। কিন্তু এমন কোন ইঙ্গিত নেই যে ইহা ব্যাপক হারে ছড়াবে”, বলছিলেন ডা. হিউ অ্যাডলার। তিনি এখনো মনে করছেন এই প্রাদুর্ভাব নিজে নিজেই শেষ হবে। কিভাবে এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে সেটি জানতে পারলে পরে কি হতে যাচ্ছে সেটি অনুমান করা সহজ হবে।

কার মাধ্যমে কিভাবে ছড়াচ্ছে এই বিষয়ে চিত্র এখনো পরিষ্কার নয়। বরং সংক্রমণের ঘটনাগুলো সম্পর্কিত নয় মনে হচ্ছে। এর যোগ সূত্র এখনো পাওয়া যায়নি। যদি এমন হতো যে অনেকে এক সাথে কোন উৎসবে যোগ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, বাড়ি নিয়ে গেছেন, অন্যদের সংক্রমণ করেছেন, অন্য দেশে নিয়ে গেছেন তাহলে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজ হতো।

কোন যোগাযোগ নেই এমন মানুষদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ানোর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, দীর্ঘ দিন যাবৎ ভাইরাসটি হয়ত মানুষের মধ্যেই ছিল, ধীরে ধীরে জেঁকে বসেছিল যা নজর এড়িয়ে গেছে।
যাই হোক, সামনে হয়ত আমরা আরো সংক্রমিত ব্যক্তি পাবো।

লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের অধ্যাপক জিমি হোয়াইটওয়ার্থ বলছেন, “আমার মনে হয় না সাধারণ মানুষের এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। তবে আমরা ইহা সম্পর্কে পুরোটা উদঘাটন করে উঠতে পারিনি এবং বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।”

তবে কোভিডের সময় যেমন ছিল এই ভাইরাসটির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই রকম নয় । মাংকি পক্স পরিচিত ভাইরাস এবং এর চিকিৎসা ও টিকা ইতি মধ্যেই রয়েছে।
এর লক্ষণ হালকা হলেও শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের ক্ষেত্রে মাংকি পক্স বিপজ্জনক। ইহা কোভিডের চেয়ে ধীরে ছড়ায়। এর সংক্রমণে ত্বকে যে ফোস্কা দেখা দেয় সে কারণে লক্ষণ গুলো ধরা সহজ। যার কারণে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত করা এবং ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের টিকা দেয়া সহজ হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক হানস ক্লুগ যদিও সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, “গ্রীষ্মকাল (ইউরোপে) যত এগিয়ে আসবে…গণজমায়েত, উৎসব, অনুষ্ঠান হবে, আমি উদ্বিগ্ন যে তাতে সংক্রমণ হয়ত ত্বরান্বিত হতে পারে।”

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *