অ্যান্টোনিন প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথ, স্প্যানিশ ফ্লু বিশ্বকে যুগ যুগ ধরে কাঁদিয়েছে
করোনা প্রথম নয়। এ রকম প্রাণঘাতী রোগ বিভিন্ন সময়ে অতিমারি বা মহামারি রূপে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে মানব সভ্যতার উপর।
২০২০-র শুরু থেকেই পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। বিশ্বের এক কোটি মানুষ ইতি মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন কোভিডে। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে এই ভাইরাসের ছোবল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগকে অতিমারি ঘোষণা করেছে। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজছে সব দেশ।
তবে করোনা প্রথম নয়। এ রকম প্রাণঘাতী রোগ বিভিন্ন সময়ে অতিমারি বা মহামারি রূপে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে মানব সভ্যতার উপর। কিন্তু সে সব ঝাপটা কাটিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। দেখে নেওয়া যাক, পৃথিবীর বুকে তছনছ চালানো কিছু অতিমারি ও মহামারির কথা।
আথেন্সের মহামারি: খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০, গ্রিসের আথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে শুরু হয়েছে পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ। সেই সময়ই আথেন্সে এক অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তা আকার নিল মহামারির। তবে কী রোগের কারণে এই মহামারি, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেসের বর্ণনা অনুযায়ী, “স্বাস্থ্যবান লোকেদের কপালের তাপ মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেল। চোখ লাল ও জ্বালা জ্বালা ভাব। জিভ-গলাতেও লালচে ভাব।’’ এর জেরে প্রায় এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরে লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরেও এই রোগ ছড়ায়।
অ্যান্টোনিন প্লেগ: ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোম সাম্রাজ্যে ছড়িয়েছিল অ্যান্টোনিন প্লেগ। এই রোগকে গুটি বসন্তের প্রাথমিক আবির্ভাব বলে মনে করা হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরা সৈনিকদের মাধ্যমেই রোমে সাম্রাজ্যে ছড়িয়েছিল ইহা । জ্বর, গলা ব্যাথা, ডায়ারিয়ার লক্ষণ ছিল এই রোগে। এই অতিমারি ৫০ লক্ষ লোকের প্রাণ কেড়েছিল। এর জেরে এক দিনে দু’হাজার মৃত্যুর সাক্ষীও থেকেছে রোম।
সাইপ্রিয়ান প্লেগ: অ্যান্টোনিনের বছর সত্তর পর আর এক অতিমারির ধাক্কা সহ্য করে মানব সভ্যতা । তিউননিশিয়ার কার্থেজ শহরের বিশপ সাইপ্রিয়ানের নামে নামকরণ করা হয় এই অতিমারির। মনে করা হয়, ২৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে ইথিওপিয়াতে সাইপ্রিয়ান প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। উত্তর আফ্রিকা হয়ে রোমে ঢোকে ইহা। তার পর ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে। অ্যান্টোনিনের সঙ্গে এই রোগের লক্ষণের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এই অতিমারিও প্রচুর প্রাণ কেড়েছিল সে সময়।
জাস্টিনিয়ান প্লেগ: ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে এর সূত্রপাত মিশরে। তার পর প্যালেস্তাইন ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্য হয়ে ভূমধ্যসাগরীয় দেশ গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামেই এর নামকরণ। এই অতিমারিকেই প্রথম দফার বুবোনিক প্লেগ হিসাবে ধরা হয়। মনে করা হয়, পৃথিবীর সে সময়ের জন সংখ্যার প্রায় দশ শতাংশের মৃত্যু হয়েছিল এই অতিমারিতে। জাস্টিনিয়ানও আক্রান্ত হয়েছিলেন এই রোগে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁর সাম্রাজ্যের বাঁধন আলগা করে দিয়েছিল এই অতিমারি।
ব্ল্যাক ডেথ: চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির ত্রাস হয়ে উঠেছিল ব্ল্যাক ডেথ। বুবোনিক প্লেগের শক্তিশালী রূপে ফিরে আসার জেরেই ১৩৪৭ নাগাদ হয় এই অতিমারি। এই ব্ল্যাক ডেথ অতিমারির জন্য দায়ী ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামে ব্যাকটিরিয়ার এক প্রজাতি। যা আজ প্রায় অবলুপ্ত। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের দেহে বসা মাছির মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছিল।
এশিয়ায় শুরু হয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ। পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে এটি। এর জেরে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় আক্রান্তদের দেহ গণ কবর দেওয়া হত। ব্ল্যাক ডেথ এত মানুষের জীবন কেড়েছিল যে, এই অতিমারির পর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উল্লেখ যোগ্য বদল ঘটেছিল।
সে সময় ইউরোপে কাজের জন্য শ্রমিকের আকাল দেখা দিয়েছিল।
আমেরিকান প্লেগ: পঞ্চদশ শতাব্দির শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দির শুরুর বছর। ইউরোপীয়রা পৌঁছে গিয়েছে দুই আমেরিকা মহাদেশের নানা প্রান্তে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে গিয়েছে ইউরোপে হওয়া গুটি বসন্ত, হাম, বুবোনিক প্লেগের মতো রোগ।
এই সময়কালে গুটি বসন্তে মেক্সিকোর অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ইনকা সভ্যতাতেও প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে থাকে এই রোগগুলি। দশকের পর দশক ধরে ধরে ওই সব অঞ্চলে ফিরে ফিরে আসতে থাকে ইউরোপের রোগগুলি। সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে, এই সব রোগের কবলে পড়ে ওই শতকে সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন: বিশ্ব জুড়ে ‘সন্ত্রাস’ চালানো ব্ল্যাক ডেথ, প্রায় ৩০০ বছর পর ফিরে আসে লন্ডনে। ১৬৬৫-র গ্রীষ্মে লন্ডন জুড়ে দ্রুত হারে ছড়াতে থাকে এই রোগ। এর জেরে লন্ডনের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, প্রায় এক লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। সে বছর সেপ্টেম্বরের এক সপ্তাহে সাত হাজার ১৬৫ জনের মৃত্যু নথিভুক্ত রয়েছে এই মহামারির কারণে। এর কয়েক বছর আগে ইটালিতেও লক্ষাধিক লোকের প্রাণ কেড়েছিল এই প্লেগ।
প্রথম কলেরা অতিমারি: উনবিংশ শতকের শুরুর সময়ে বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ অতিমারির চেহারা নেয় কলেরা। ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমির বদ্বীপ অঞ্চলে প্রথম ছড়ায় এই রোগ। ১৮১৭-তে যশহরে প্রথম দেখা দেয় এই রোগ। তার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-সহ, বিশ্ব জুড়ে প্রায় সাত বছর ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে কলেরা। ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটিরিয়া কলেরার জন্য দায়ী। ইহা মূলত: জলবাহিত রোগ। ব্যাকটিরিয়া মিশ্রিত জল ও খাবারের মাধ্যমে ইহা ছড়িয়েছিল।
বঙ্গে শুরু হওয়ার পর সারা ভারতে-সহ মায়ানমার, শ্রীলঙ্কাতেও ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। ১৮২০-তে তাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াতেও থাবা বসায় ভিব্রিও কলেরি। কলেরার জেরে শুধু জাভা দ্বীপেই এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।