ঔষধজনিত লিভার সমস্যাঃ

আমরা প্রতিদিন হরেক রকম খাদ্য গ্রহণ করি। অসুস্থ মানুষদের নানাবিধ রোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ সেবন করতে হয়। আমরা খাদ্যনালি দিয়ে যত প্রকার
বস্তুই গ্রহণ করি না কেন সব কিছুই প্রাথমিক পরিপাকের পর অন্ত্রের রক্ত নালি দিয়ে প্রথমে লিভারে প্রবেশ করে। এরপর লিভার থেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে ঋদ পিণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছেড়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আমাদের গৃহীত খাদ্যে নানা ধরনের কেমিক্যাল উপস্থিতির কারণে লিভারকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ঘাত-প্রতি- ঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন কাজে ব্যস্ত লিভার মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তন করতে গিয়ে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার মাত্রাতি- রিক্ত ঔষধের ডোজ পড়ে গেলেও লিভার ইনজুরি হতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন লিভারের ক্ষতি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হতে পারে। এর মধ্যে ড্রাগ অতিরিক্ত মাত্রায় বা দীর্ঘ সময় ধরে সেবনের ফলে সরাসরি লিভারের ক্ষতি করতে পারে। অন্যদিকে লিভার ইনজুরির মূল কারণটা অজানা থাকে। যাকে বলা হয় ইডিওসিন- ক্র্যাটিক রিএকশন।

তবে ধারণা করা হয় যে , ইডিওসিনক্র্যাটিক রিঅ্যাকশন বিপাক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত কিছু জৈব-রাসায়- নিক প্রক্রিয়ার মিশ্র মিথষ্ক্রিয়ায় হয়ে থাকে। সাধারণতঃ ঔষধ খাওয়ার ৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এই রিঅ্যাকশন হতে পারে। মানুষের জিন গত কারণে ইডিওসিনক্র্যাটিক রিএকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির কোন ঔষধে সমস্যা হবে সেটা আগে থেকে কখনই নির্ণয় করা যায় না। বাংলাদেশে ঔষধ জনিত লিভার ইনজুর ঘটনা কম।

সারা বিশ্বে লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশে – ষজ্ঞরা যত বেশি রোগী দেখেন তার এক শতাংশের কম হলো ঔষধজনিত লিভার রোগী। আমেরিকা ও ইউরোপের একিউট লিভার ফেইলুর সংক্রান্ত যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় তার প্রধান কারণ হলো ঔষধ জনিত লিভার রোগ।

ঔষধ জনিত লিভার ফেইলুর প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও চিকিৎসা না করতে পারলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯০% । সুতরাং ঔষধজনিত লিভার ইনজুরির ঘটনা
সংখ্যায় কম হলেও পরি – ণতিতে
মারাত্মক।

যে কোনো ধরণের ঔষধই লিভার ইনজুরি করতে পারে। তবে সাধারণতঃ যে ঔষধ- জনিত লিভার ইনজুরি বেশি পাওয়া যায় সেগুলো হলো-প্যারাসিটামল, আইসো- নিয়াজিড়, মিথোট্রিক্সেট, ফিনাইটয়েন এবং ভ্যালপ্রোয়েট।

কিছু ঔষধ আছে ডোজ ভিত্তিক ইনজুরি করে, ডোজ একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হলে লিভারের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং যত বেশি ডোজ হবে ইনজুরির মাত্রা তত বেশি হয়। এই ধরনের ঔষধের মধ্যে আছে-প্যারাসিটামল এবং মিথোট্রিক্সট। প্যারাসিটামল একটি সহজলভ্য ঔষধ, যা জ্বর ও ব্যথার জন্য ডাক্তাররা লিখে থাকেন। ঔষধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওটিসি ড্রাগ হিসেবে পাওয়া যায়।

একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত প্যারাসিটামল লিভারে কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। তবে কেউ যদি এক সাথে ৭.৫ গ্রাম ঔষধ খেয়ে ফেলে তার নিশ্চিত ভাবেই লিভার ইনজুরি হবে। অন্যদিকে মিথোট্রিক্সেট ঔষধটি বিভিন্ন রিউম্যাটোলজিক্যাল ও রক্তরোগে ব্যবঋত হয়। ডাক্তারদের উপদেশকৃত ডোজের চেয়ে বেশি মাত্রায় বা ঘন ঘন খেলে এটি লিভার ইনজুর করতে পারে।

আইসোনিয়াজিড ও রিফামপিসিন ঔষধ দুটি যক্ষ্মার চিকিৎসায় খেতে হয় প্রায় ছয় মাস। যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য ঔষধ দুটি যে মাত্রায় সেবন করতে বলা হয় সাধারণতঃ সে মাত্রায় এরা কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে না।

তবে কোন কোন কারণে ঔষধ দুটি লিভার ইনজুরি ও তৎজনিত জন্ডিসের কারণ হতে পারে। প্রোপাইল থায়োইউরাসিল হল হাইপারথাইরয়েডিজম নামক থাইরয়েড রোগের ঔষধ। ফিনায়টয়েন ও ভ্যালপ্রোয়েট প্রেসক্রাইব করা হয় খিচুনী নিয়ন্ত্রণ করতে। এ ঔষধ গুলো রিঅ্যাকশন করে লিভার ইনজুরি করতে পারে। স্বল্প মেয়াদি লিভার প্রদাহে আক্রান্ত রোগী বা সিরোসিসের রোগী ভেষজ ঔষধ খেলে লিভার ফেইলুর হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।

ঔষধ জনিত লিভার রোগীরা বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে। কোন কোন রোগীর স্বল্প মেয়াদি লিভার প্রদাহের মত জন্ডিস, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

কারও কারও লিভার সিরোসিসের ন্যায় লক্ষণ প্রকাশ পায়। কেউ আবার লিভার ফেইলুর নিয়ে হাসপাতালে আসে। আবার কিছু মানুষের কোন লক্ষণই থাকে না। শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা ALT বা AST স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। লিভার ফেইলিউর হলে রোগী এলোমেলো বকে বা চেতনা লোপ পায়।

ঔষধের কারণে সৃষ্ট লিভারের ক্ষতি নির্ণয় করার ক্ষেত্রে রোগী কি ঔষধ খাচ্ছে বা খেয়েছেন তা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্যান্য লিভার রোগ নেই এটি নিশ্চিত হওয়া গেলেই ধারণা করা হয় যে সংশ্লিষ্ট লিভার ইনজুরি ঔষধের কারণে হয়েছে। রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনে রক্তের টেস্ট এর পাশা পাশি লিভার বায়োপসিও করা লাগে।

লিভারের ক্ষতি ঔষধ থেকে হয়েছে নিশ্চিত হওয়া গেলে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ঔষধটি বন্ধ করে দেয়া। ইনজুরির মাত্রা কম হলে অনেক সময় ঔষধ বন্ধ করার অল্প দিনের মধ্যে লিভারের ফাংশন ঠিক হয়ে আসে। রিঅ্যাকশনের জন্য মূল চিকিৎসা হলো ঔষধ বন্ধ করে সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেয়া।

তবে লিভার ফেইলুর হয়ে গেলে অতি দ্রুত লিভার প্রতিস্থাপন করাই হচ্ছে সর্বশেষ চিকিৎসা। এছাড়া লক্ষণ ও কারণ ভেদে ভিটামিন কে, আর্সোডিঅক্সিকলিক অ্যাসিড এবং স্টেরয়েড ঔষধও উপকারে আসে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *